Ayurveda গেঁয়ো যোগী আসলে ভিখ পায় না। তাই আমাদের ঘরের বাইরে যে চিরঞ্জীব বনৌষধির ভাণ্ডার আছে, আমরা তাকে বিজ্ঞানের আলোকে মানতে রাজি নই। আমাদের মা-ঠাকুমারা যে জীবনধারা, যে দিনচর্যা যাপন করতেন সে সব আজকের যুগের তুলনায় কিছুটা সেকেলে হলেও, তার কিছুটাও যদি আমরা রপ্ত করতে পারি, তা হলে লাভ বই ক্ষতি নেই। বরং বিজ্ঞানের আতসকাচ চোখে সে সব পুরনো Ayurveda আয়ুর্বেদিক উপায়ে আমরা রোগ প্রতিরোধের কঠিন অঙ্ক সহজেই সমাধান করতে পারি। ‘আয়ু’ শব্দের অর্থ ‘জীবন’ এবং ‘বেদ’ শব্দের অর্থ ‘বিশেষ জ্ঞান’।
Ayurveda ‘আয়ুর্বেদ’ শব্দে বোঝায়জীবনের বিজ্ঞান। অর্থাত্ যে বিজ্ঞানের মাধ্যমে দীর্ঘায়ু লাভ ও জীবের কল্যাণসাধন হয়, তা-ই আয়ুর্বেদ। সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো আয়ুর্বেদ আদতেভেষজ উদ্ভিদ, প্রাণীজ ও খনিজ দ্রব্যের মাধ্যমযুক্ত চিকিত্সাপদ্ধতি। আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মূল লক্ষ্য দু’টি। প্রথমত, ‘স্বস্থস্য স্বাস্থ্য রক্ষনম’— অর্থাৎসুস্থের স্বাস্থ্য রক্ষা করা এবং দ্বিতীয়ত, ‘আতুরস্য বিকার প্রশমনন চ’— অসুস্থের চিকিৎসা করা। সুস্থ লোকের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে প্রাচীন আয়ুর্বেদ কিছু বিধিনিষেধ বর্ণনা করেছে। যেখানে দৈনন্দিন জীবনধারার নিয়মকে বলা হয় ‘দিনচর্যা’, যেমন ব্রাহ্ম মুহূর্তে জাগা (সূর্যোদয়ের ৪৮মিনিট আগে), ঊষাপান, শৌচকর্ম, দন্তধাবন (নিম, বকুল, বাবুল, করঞ্জ, খয়ের ইত্যাদির নরম ডাল দিয়ে দাঁত মাজা), নস্য (নারকেল তেল বা তিল তেল দুই ফোঁটা নাকে দেওয়া), কবল/কুলকুচি (তিল তেল, ত্রিফলা ক্বাথ ইত্যাদির দ্বারা), সারা শরীরে খাঁটি তেল দিয়ে মালিশ করা,ব্যায়াম করা,স্নান ও পরিষ্কার বস্ত্রধারণ।
রাত্রিকালীন জীবনধারার নিয়মকে বলা হয় ‘রাত্রিচর্যা’। যেমন, সূর্যাস্তের পর খাদ্যগ্রহণ (নৈশভোজন), আহারের পর একশো কদম পায়ে হাঁটা, পায়ের পাতায় তেলমালিশইত্যাদি। আর সর্বশেষ ঋতুভিত্তিক জীবনধারার নিয়মকে বলা হয় ‘ঋতুচর্যা’। এই তিন জীবনধারা আমাদের নীরোগ রাখে ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। আয়ুর্বেদের দৈনন্দিন আহারবিধিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছেচরক সংহিতার সূত্র স্থান, মাত্রাশীতিয় ও অন্নপান বিধি অধ্যায়ে। বৈজ্ঞানিক আঙ্গিকে দৈনন্দিন, রাত্রিকালীন ও ঋতুকালীন জীবনধারার প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা আছে এই শাস্ত্রে।
উদাহরণস্বরূপ, Ayurveda আয়ুর্বেদের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, ‘ভাবপ্রকাশ’-এ তামার পাত্রে আগের রাতে রাখা ঢাকা দেওয়া জল পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পান করার কথা উল্লেখ আছে।এই দিনচর্যার নিয়মটিকে বলা হয়, ‘ঊষাপান’। আধুনিক স্বাস্থ্যসচেতন যুগে একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, তামানির্মিত জলের জগ, গ্লাস, পাত্রের ক্রয়বিক্রয় অনেক অংশে বেড়ে গিয়েছে। এর কারণ, প্রত্যেকটি ধাতু তার ক্ষমতাবলে জীবাণুকে নাশ করে। এই ক্ষমতাকে বলে ‘অলিগোডাইনামিক এফেক্ট’। প্রত্যেকটি ধাতুর এই ক্ষমতা অল্পবিস্তর থাকলেও তামার এই ক্ষমতা অদ্ভুত রকমের বেশি।
বর্তমান পৃথিবীর ত্রাস করোনাভাইরাসটিও প্লাস্টিক বা স্টিলের ওপর ৭২ ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে, অথচ তামার উপর ভাইরাসটির প্রাণভোমরা মাত্র চার ঘণ্টা।ভারতীয় আয়ুর্বেদহাজার হাজার বছর আগে তামার পাত্রের মাহাত্ম্য আবিষ্কার করে গিয়েছে। দিনচর্যা উল্লিখিত কবল বা কুলকুচির উপর আলোকপাত করলে দেখা যায়, ত্রিফলা, হলুদ ইত্যাদি সংযোগে কুলকুচি করতে বলা হয়েছে। কলকাতার আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজেরসাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ত্রিফলা, হলুদ ওমধু মিশিয়ে ব্যবহার করলে মুখের প্রাক ক্যানসার অবস্থা বা ওরাল সাব মিউকসাল ফাইব্রোসিসের ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে।
আবার বরোদার কেএমশাহ ডেন্টাল কলেজেও একই ধরনের গবেষণায় ত্রিফলা ব্যবহার করে ওরাল সাব মিউকসাল ফাইব্রোসিসের ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ইমিউনিটি বা রোগপ্রতিরোধকে তিন ভাগে ভাগ করেছে। আয়ুর্বেদেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমউনিটিকে তিন ভাগে করা হয়েছে। যাকে ‘বল’বা ‘ব্যাধি ক্ষমত্ব’ বলে।
সহজবল:প্রাকৃতিক বা ন্যাচারাল, যেটা মানুষ জন্মসূত্রে পায়। কালজবল: এই বল বা ইমউনিটি নির্ভর করে সময়, ঋতু বা বয়স অনুসারে। যুক্তিকৃতবল: যে বল বা ইমউনিটি মানুষ জীবনকালে অর্জন করে, যাকে আমরা ‘অ্যাকোয়ার্ড ইমউনিটি’ বলি। ভ্যাকসিন বা টিকা এই গোত্রের মধ্যে পরে। যদিও ভ্যাকসিন বা টিকা সেই সময় আবিষ্কৃত হয়নি, তবুও আমাদের দেশীয় চিকিৎসা এতটাই উন্নত ছিল যে এই যুক্তিকৃত বল বা আ্যকোয়ার্ড ইমউনিটিকে কী করে বাড়ানো যায়, তার একটা স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়াও Ayurveda আয়ুর্বেদে এক ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি আছে, যাকে ‘রসায়ন চিকিৎসা’বলে।তা এই যুক্তিকৃত বলকে বাড়াতে সাহায্য করে। রসায়ন চিকিৎসাকে আয়ুর্বেদ এতই প্রাধান্য দিয়েছে যে আয়ুর্বেদের প্রধান আটটি অঙ্গের মধ্যেএই রসায়ন চিকিৎসা (জেরিয়াট্রিক মেডিসিন)ঠাঁই পেয়েছে। তাই চরক সংহিতার চিকিৎসা স্থানের প্রথম অধ্যায়ের নামই হল‘রসায়নপাদ’। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে অনেক নিয়মনীতি, ভেষজ ও ওষুধেরউল্লেখ আছে, যাতে আমাদের শরীর নীরোগ ও তারুণ্যময় থাকে। আমাদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে আমরা সহজে রোগাক্রান্ত হব না।তাই এই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য আমাদের বল বা ইমউনিটি পাওয়ার বাড়াতে হবে। আয়ুর্বেদে প্রচুর পথ্য আর ভেষজেরউল্লেখ আছেযা এই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগেই যে গাছগুলো বা পথ্যগুলো বলা হয়েছে, আজকের দিনে আধুনিক বিজ্ঞান সেই ভেষজকে সিলমোহর দিচ্ছে। যেমন:
ত্রিফলা: আমলকি, হরীতকী ও বহেড়া— এই তিনটি ফল একত্রে বলা হয় ‘ত্রিফলা’। Indian gooseberry or amla আমলকির উপকারিতার জন্য এই ফলকে Ayurveda আয়ুর্বেদে ‘অমৃতফল’বলে। আরহরীতকীকে আয়ুর্বেদে ‘মাতা’ বলা হয়েছে। মা যেমন সন্তানকে আগলে রাখেন, তেমন হরীতকীও আমাদের দেহকে রোগ থেকে বাঁচিয়ে রাখে। হরীতকী, বহেড়ার মধ্যে আছে চেবুলাজিক আ্যসিড, গালিক আ্যসিড, অ্যালাজিক আ্যসিড ইত্যাদি। যা শরীরের ক্ষতিকারক প্রদাহ সৃষ্টিকারী ফ্রি র্যাডিক্যালসকে নষ্ট করে দেয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে হরীতকী ইনফ্লুয়েঞ্জা ‘এ’ভাইরাসের উপর কার্যকরী।
গ্রাম পজিটিভ ব্যাক্টিরিয়ারউপর বহেড়া খুবই ভাল কাজ করে। প্রদাহের স্থানে শ্বেত রক্তকণিকা যেমন নিউট্রোফিল, মাক্রোফাজ ইত্যাদিদের সঞ্চালনের কাজকে প্রশস্ত করে। আমলকীর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ক্ষমতার জন্য যে চার যৌগ দায়ী, তারা এমব্লিকানিন এ, এমব্লিকানিন বি, পুনিগ্লুকোনিন ও পেডুনক্লাজিন।এই চারটি ট্যানিন জাতীয় উদ্ভিজ যৌগ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে এই আমলকি শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা ও লিম্ফোসাইট বিস্তারের শতকরা হারকে বাড়িয়ে তোলে। ত্রিফলার ‘প্রোকাইনেটিক’গুণ আছে যার জন্য প্রাকৃতিক উপায়ে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।রোজ রাতে এক চামচ ত্রিফলা চূর্ণ গরম জলের সঙ্গে পান করলে শরীরের প্রভূত উপকার হয়।
গুলঞ্চ: গুলঞ্চ আমাদের দেশে অতি পরিচিত লতানে গাছ।আমাদের শরীরের শ্বেত রক্তকণিকারাশরীরে কোনও জীবাণু ঢুকলে আক্ষরিক অর্থে তাকে গিলে নেয়। এই পদ্ধতিকে বলে ‘ফ্যাগোসাইটোসিস’। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গুলঞ্চ এই গোসাইটোসিস পদ্ধতির হারকে বাড়িয়ে তোলে এবং সিরাম অ্যান্টিবডির পরিমাণকে বাড়িয়ে তোলে। গুলঞ্চ সত্ত্ব আয়ুর্বেদে জ্বরের পশমকারী পথ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। গুলঞ্চর কাড়া বা ক্বাথ বানিয়ে পান করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। বুকের ক্রনিক সংক্রমণও সারে।
তুলসি: আমাদের ঘরের উঠোনের এই গাছ বহুল পরিচিত। এর উপকার বহু শতক ধরে আমাদের বাড়ির মা-ঠাকুমারা ভাল ভাবেই রপ্ত করেছেন। তুলসিতে আছে ওলেয়ানলিক আ্যসিড ও আরসলিক আ্যসিড।এটি প্রদাহনাশক এবং নানা ভাইরাস— যেমন রোটা ভাইরাস, হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ইত্যাদির উপর বিশেষ ভাবে কার্যকরী। তা ছাড়া ভাইরালজনিত জ্বরেও এটি খুবই উপকারী।
হলুদ: হলুদের অপরিসীম গুণ। আমাদের দৈনন্দিন খাবারে তার উপস্থিতিই প্রমাণ করে তা শরীরে জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৭ সালে ফ্রান্সের একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা যায় যে হলুদে উপস্থিত যৌগ কারকুমিন জিকা ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসকে দমন করতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও ইনফ্লুয়েঞ্জা ও হেপাটাইটিস ভাইরাসের উপর হলুদ সমান কার্যকরী। সকালবেলায় খালি পেটে ৫ গ্রাম হলুদ গুড় সহযোগে খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, শরীরের প্রদাহ নাশ হয়, ত্বকের জেল্লা বাড়ে ও হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি ব্যাক্টিরিয়ার হানায় পেটে হওয়া আলসারেও উপকার পাওয়া যায়।
কালোমরিচ: কালো মরিচে আছে পাইপেরিন।একে আধুনিক বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ‘বায়োঅ্যাভেলিবিলিটি এনহানসার’। মানে, পাইপেরিনের উপস্থিতিতে অন্য ওষুধ আরও ভাল করে কাজ করে। আমাদের খাবারে একটু কালো মরিচ যুক্ত করলে স্বাদের সঙ্গে গুণও বাড়ে।এছাড়াও শুকনো কাশিতে মরিচের গুঁড়ো আর তালমিছরি চেটে খেলে অনেকটা আরাম পাওয়া যায়।
অশ্বগন্ধা: অশ্বগন্ধায় আছে উইথানোলাইড। অশ্বগন্ধা নার্ভের টনিক হিসেবে কাজ করে এবং বিষণ্ণতা, টেনশন, মানসিক চাপে খুবই ভাল কাজ করে। নার্ভের অসুখ ও অনিদ্রা থাকলে রোজ রাতে গরম দুধের সঙ্গে এক চামচ অশ্বগন্ধা সেবন করলে উপকার পাওয়া যায়।
মনোক্কা: সুস্বাদু মনোক্কাতে আছে ভরপুর আয়রন। তবে কিশমিশের মতো এটি বীজহীন আর স্বাদে আম্লিক নয়। এর ত্বকে ও বীজে আছে অতি গুরুত্বপূর্ণ যৌগ রেসভেরাট্রল যা জীবাণুনাশক ও ক্যানসারের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর অতি উত্তম ভেষজ। এ ছাড়া রোজ রাতে দুই থেকে তিনটে মনোক্কা জলে ভিজিয়ে পরের দিন খেলে শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। আমাদের ভারতে মোট উদ্ভিদের সংখ্যা ৫০ হাজারের মতো। প্রত্যেকটি গাছ গাছড়ারই নানা গুণ আছে। ২০১৫ সালে চিনা বৈজ্ঞানিক তু ইউ ইউ মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার পান। ওঁর বিষয় ছিল প্রাচীন চিনা শাস্ত্রীয় ঔষধ। সেই নোবেলপ্রাপ্তি চিনের নব্য গবেষকদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আমাদের দেশেওআয়ুর্বেদ নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। তবেই উন্নত চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোয় আয়ুর্বেদের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ আরও ব্যাপক হারে সম্ভব হবে।