সম্প্রতি, ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্টস) তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্র। আগে থেকেই এর সূচক নিম্নগামী হওয়ার ইঙ্গিত মিলেছিল। তবে জিডিপি যে অস্বাভাবিক নেমে যাবে, তার আঁচ দিতে পারেনি কোনও সমীক্ষক সংস্থাই। জিডিপির হার প্রকাশ করে জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর (ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিস বা এনএসও)। কেন্দ্রীয় সংস্থাটি জানিয়েছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৪ শতাংশ, গত আড়াই বছরের মধ্যে যা সর্বনিম্ন।
গত অর্থবর্ষের (২০২৩-২৪) একই ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার ৮.১ শতাংশ ছিল বলে জানিয়েছে এনএসও। এখন প্রশ্ন হল, কী এই জিডিপি? এর সূচকের ঊর্ধ্বমুখী থাকা রাষ্ট্রের আর্থিক স্বাস্থ্যের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ? বিশেষজ্ঞদের কথায়, একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত যাবতীয় পণ্য এবং পরিষেবার মোট মূল্যকে অর্থনীতির পরিভাষায় বলা হয় জিডিপি। সাধারণত, একটি অর্থবর্ষের এক চতুর্থাংশ, অর্থাৎ প্রতি তিন মাস করে জিডিপির সূচক পরিমাপ করা হয়। এর মাধ্যমে কোনও দেশের আর্থিক বৃদ্ধি বিচার করেন বিশ্লেষকেরা।
অন্য রাষ্ট্রের আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে তুলনার ক্ষেত্রেও জিডিপির সূচক ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। জিডিপির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতির আকার, বৃদ্ধির হার এবং সামগ্রিক ভাবে আর্থিক স্বাস্থ্য বোঝার সুযোগ থাকে। এর সূচকের উপর ভিত্তি করে লগ্নির বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন বিনিয়োগকারী ও শিল্পপতিরা। ক্রমবর্ধমান জিডিপি সমৃদ্ধশালী অর্থনীতির পরিচায়ক। অন্য দিকে, জিডিপি নামলে তা আর্থিক সঙ্কটের সঙ্কেত বলে ধরা হয়। ভারতের ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন নীতি, বাজেট বরাদ্দ এবং আর্থিক বাজারকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে মূল নির্ণায়ক শক্তি হিসাবে জিডিপিকেই গণ্য করেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
এ ছাড়া ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মতো উদ্যোগের কার্যকারিতা বুঝতে সাহায্য করে জিডিপি। পাশাপাশি এর সাহায্যেই কৃষি, উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্রের অগ্রগতি নির্ণয় করা হয়। অর্থনীতির পরিভাষায় মূলত তিন ধরনের জিডিপি রয়েছে। সেগুলি হল, নামমাত্র বা নমিনাল, প্রকৃত বা রিয়্যাল এবং মাথাপিছু বা পার ক্যাপিটা জিডিপি। বর্তমান মূল্যে প্রাথমিক ভাবে পাওয়া আর্থিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে নামমাত্র জিডিপিকে পরিমাপ করা হয়। মুদ্রাস্ফীতির জন্য একে দায়ী করা হয় না। দাম উল্লেখযোগ্য ভাবে বদলে গেলে আর্থিক বৃদ্ধির বিকৃত সূচক দেখতে পাওয়ার সুযোগ থাকে নামমাত্র জিডিপির ক্ষেত্রে।
অন্য দিকে, মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রকৃত জিডিপি পরিমাপ করা হয়। স্থির মূল্যের উপর এর সূচকের ওঠাপড়া নির্ভর করে। ফলে এতে আর্থিক বৃদ্ধির পরিষ্কার চিত্র দেখতে পাওয়ার সুযোগ থাকে। আর্থিক বৃদ্ধির তুলনামূলক আলোচনার ক্ষেত্রেও প্রকৃত জিডিপির তথ্য ব্যবহার করেন বিশ্লেষকেরা। মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে আর্থিক বৃদ্ধির সূচককে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হয়। এতে জনপ্রতি গড় আয় জানার সুযোগ থাকে। দেশের আমজনতার জীবনধারণের মান জানার ক্ষেত্রে মাথাপিছু জিডিপির সূচক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিডিপি পরিমাপের অন্যতম উপায় হল ‘উৎপাদন পদ্ধতি’ (প্রোডাকশান মেথড)। একে মূল্য সংযোজন পদ্ধতি হিসাবে অনেকে উল্লেখ করে থাকেন। এতে উৎপাদনের প্রতিটা পর্যায়ে সংযোজিত মূল্যকে যোগ করে। মূলত শিল্পক্ষেত্রে আর্থিক বৃদ্ধির হার জানতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
এ ছাড়া ‘ব্যয় পদ্ধতি’র (এক্সপেনডিচার মেথড) মাধ্যমেও জিডিপির হার গণনা করে থাকেন পরিসংখ্যানবিদ ও গণিতবিদেরা। এতে রাষ্ট্রের যাবতীয় খরচের খতিয়ান ধরা থাকে। এর মধ্যে রয়েছে সরকার চালানোর ব্যয় এবং আমদানি খরচ। পাশাপাশি রফতানি, বিনিয়োগ এবং যাবতীয় পণ্য কেনাবেচার হিসাবও এর মাধ্যমে জিডিপির সূচকে প্রতিফলিত হয়। জিডিপি নির্ধারণের সর্বশেষ নিয়মটি হল ‘আয় পদ্ধতি’ (ইনকাম মেথড)। মজুরি, ভাড়া, সুদ এবং লাভ-সহ অর্থনীতিতে অর্জিত সমস্ত আয়ের যোগফলের উপর নির্ভর করে এই পদ্ধতিতে জিডিপি পরিমাপ করা হয়। ভারতের জিডিপির হার গণনা করে পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রক। নির্ভুল ভাবে আর্থিক বৃদ্ধির হার পরিমাপ করতে উৎপাদন এবং ব্যয় দু’টি পদ্ধতিই ব্যবহার করে থাকে তারা।
শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রের সমীক্ষা এবং শিল্প ও পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলির আর্থিক প্রতিবেদন-সহ বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তবে জিডিপির মাধ্যমে কী ভাবে নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের বাঁটোয়ারা হয়েছে, তা বোঝা সম্ভব নয়। ভারতের মতো দেশে আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার বাইরেও আর্থিক কাজকর্ম এবং ব্যবসা চলে। সেগুলি জিডিপির আওতাভুক্ত নয়। এই সূচক পরিবেশগত অবক্ষয় এবং স্থায়িত্ব বিবেচনা করে না। প্রসঙ্গত, অবৈতনিক কাজ জিডিপির আওতাভুক্ত নয়। ফলে স্বেচ্ছাসেবা বা গৃহস্থালির কর্মকাণ্ডকে এর বাইরে রাখা হয়েছে। বর্তমানে আর্থিক বৃদ্ধির হিসাব কষার জন্য ভিত্তিবর্ষ বদলের কথা ভাবছে কেন্দ্র। এখন ২০১১-১২ সালকে ভিত্তিবর্ষ হিসাবে ধরে জিডিপির পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে সরকার।
বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন পরিসংখ্যান মন্ত্রকের সচিব সৌরভ গর্গ। তাঁর কথায়, ‘‘ভিত্তিবর্ষ বদল করে তা ২০২২-২৩ করার কাজ শুরু হয়েছে। এর জন্য ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস স্ট্যাটিস্টিক্সের ২৬ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে।’’ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন ভিত্তিবর্ষ অনুযায়ী জিডিপি গণনার ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। ২০১১-১২ সালে শেষ বার আর্থিক বৃদ্ধির হিসাবের ভিত্তিবর্ষ বদল করে কেন্দ্র। ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রী কুর্সিতে ছিলেন মনমোহন সিংহ। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে বহু বার এই ভিত্তিবর্ষ বদলের কথা উঠেছে।
কিন্তু তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। বিরোধীদের একাংশের অভিযোগ, অর্থনীতি খারাপ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার কারণেই তড়িঘড়ি ভিত্তিবর্ষ বদল করতে চলেছে কেন্দ্র। শুধু তাই নয়, নানা সময়ে তথ্য প্রকাশে অনীহার কথাও বলেছেন তাঁরা। যদিও সমস্ত অভিযোগই উড়িয়ে দিয়েছে মোদীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। অন্য দিকে, সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে জিডিপির খারাপ ফলাফল নিয়ে চিন্তার কিছু নেই বলে আশ্বাস দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ। এই অর্থবর্ষে সব মিলিয়ে বৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশ থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে জিডিপির সূচক বিপজ্জনক জায়গায় রয়েছে বলে মানতে নারাজ তাঁরা।
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হতে ক্লিক করুন Aaj Bangla হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।