আদিনাথ মন্দির Adinath Mandir বাংলাদেশের Bangladesh বিখ্যাত অন্যতম হিন্দু মন্দির। এটি Bangladesh বাংলাদেশের উপকূলীয় শহর কক্সবাজার থেকে ১২ কিমি দূরের দ্বীপ মহেশখালীতে অবস্থিত। হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবতা দেবাদিদেব মহাদেবের নামানুসারে এ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মন্দিরটি শিব মন্দিরও নামেও বহুল প্রচলিত।কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটা ইউনিয়নের ঠাকুরতলা গ্রামে এই মন্দিরটি অবস্থিত, যা সমুদ্র-সমতল থেকে প্রায় ৮৫.৩ মিটার উঁচুতে। এই মন্দিরটি মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত, যা সমতল থেকে ৬৯টি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। আদিনাথের অপর নাম মহেশ।
এই মহেশের নামানুসারে মহেশখালী। সংক্ষিপ্ত ইতিহাস Adinath Mandir আদিনাথের গোড়াপত্তন কয়েক হাজার বত্সর পূর্বে ত্রেতাযুগে। এর একটি ঐতিহাসিক সত্যতা রয়েছে যা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, রামায়ণ, পুরাণ ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়। ত্রেতাযুগে রাম-রাবণের যুদ্ধের কথা ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়।রাবণ লঙ্কা যুদ্ধে রামের সঙ্গে জয়লাভের জন্য দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে অমরত্ব বর প্রার্থনা করেন। মহাদেব এসময় কৈলাসে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। তিনি রাবণের আরধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অভীষ্ট সাধনে বর দান করেন এবং শর্ত দেন শিবরূপী উর্ধমুখী শিবলিঙ্গ কে কৈলাস হতে বহন করে লঙ্কায় নিয়ে যেতে হবে এবং পথিমধ্যে কোথাও রাখা যাবে না। যদি রাখা হয় তবে মহাদেব সেই স্থানেই অবস্থান নেবেন এবং রাবণের অভীষ্ট সাধন হবেনা।
শর্তানুসারে রাবণ শিবলিঙ্গ বহন করে লঙ্কার উদ্দেশ্য গমন করেন তবে পথিমধ্যে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের লক্ষ্যে বর্তমান মহেশখালীর মৈনাক পর্বতে থামতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে শর্তানুসারে রাবণ শিবলিঙ্গ পূনরায় উঠাতে ব্যর্থ হন এবং মহাদেব এই মৈনাক শিখরেই অবস্থান গ্রহণ করেন। Adinath Mandir শ্রী শ্রী আদিনাথ এর আবিস্কার সর্ম্পকে স্থানীয়ভাবে একটি জনশ্রুতি রয়েছে।এলাকাবাসীর মতানুসারে এই তীর্থ আবিস্কৃত এবং মর্যাদা পায় নূর মোহাম্মদ শিকদার নামক একজন সচ্ছল মুসলিম ধর্মালম্বীর মাধ্যমে। তিনি লক্ষ্য করেন তার একটি গাভী হঠাত্ দুগ্ধদান বন্ধ করে।
এ ঘটনায় তিনি রাখালের উপর সন্ধিহান হন। রাখাল বিষয়টির কারণ অণুসন্ধানে রাত্রি বেলায় গোয়ালঘরে গাভীটিকে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেখতে পায় গাভীটি গোয়ালঘর হতে বের হয়ে একটি কাল পাথরের উপর দাঁড়ায় এবং গাভীর স্তন হতে আপনা আপনি ঐ পাথরে দুধ পড়তে থাকে।দুধ পড়া শেষ হলে গাভীটি পূনরায় গোয়ালঘরে চলে যায়। রাখাল বিষয়টি নূর মোহাম্মদ শিকদার কে জানালে তিনি গুরুত্ব না দিয়ে গাভীটি বড় মহেশখালী নামক স্থানে সরিয়ে রাখেন। একদিন শিকদার স্বপ্নাদেশ পান গাভীটিকে সরিয়ে রাখলেও তার দুধ দেওয়া বন্ধ হবে না বরং সেখানে তাকে একটি মন্দির নির্মাণ ও হিন্দু জমিদারদের পুজোদানের বিষয়ে বলতে হবে।
স্বপ্নানুসারে শিকদার সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের মতানুসারে আদিনাথ মন্দিরই একমাত্র মন্দির যা, মুসলিম ধর্মালম্বী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। মৈনাক শিখরেই Adinath Mandir আদিনাথ মন্দিরের পাশে অষ্টাভূজারূপী দেবী দুর্গার একটি মন্দির রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে নূর মোহাম্মদ শিকদারই অষ্টাভূজাকে সদূর নেপাল থেকে এখানে এনে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নাদেশ পান।পরবর্তীতে নাগা সন্ন্যাসী নামক একজন সাধক ১৬১২ সালে নেপালের ষ্টেট মন্দির থেকে অষ্টাভূজাকে চুরি করে আনার সময় ধরা পড়ে জেলবণ্দি ও বিচারের সম্মুখীন হন। বিচারের পূর্ব রাত্রিতে সন্ন্যাসী যোগমায়াবলে মহাদেবের কৃপা সান্নিধ্য লাভ করেন। মহাদেব অভয় বাণী প্রদান করেন এবং বিচারকের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ইচ্ছামোতাবেক উত্তর দিতে বলেন।
পরের দিন বিচারকালে বিচারক প্রথমে নেপালের রাজা এর নিকট মূর্তির রং জানতে চাইলে রাজা কষ্টি পাথরের মূর্তি কাল রং বলে বর্ণনা দেন। একই প্রশ্ন সন্ন্যাসীকে করা হলে তিনি মূর্তির রং সাদা বলেন। পরবর্তীতে মূর্তি সকলের সম্মুখে উন্মোচন করে সাদা দেখা যায় এবং সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় ঘোষণা করা হয়। রাজা প্রকৃত ঘটনা জানতে উদগ্রীব হলে সন্ন্যাসী তাকে বিস্তারিত বলেন।পরবর্তীতে রাজা যথাযথ মর্যাদার সহিত মৈনাক শিখরে শ্রী শ্রী আদিনাথ এর পাশে মন্দির নির্মাণ করে অষ্টভূজাকে প্রতিষ্ঠান করেন। মন্দির কমিটির তত্ত্বাবধায়কের মতে এখনও নেপাল সরকার মাঝে মধ্যে মন্দিরে যথাসাধ্য অণুদান দিয়ে থাকেন। মূল আদিনাথ ও অষ্টাভূজা মন্দিরের পাশেই ভৈরব ও রাধা গোবিন্দ এর মন্দির রয়েছে। পুজো-অর্চনা প্রতিদিনই নিয়ম মোতাবেক আদিনাথ, অষ্টাভূজা, ভৈরব ও রাধা গোবিন্দ এর মন্দিরে একই সময়ে পূজো-অর্চনা হয়ে থাকে।
এছাড়া প্রতি বত্সর ফাল্গুনের শিব চতুর্দ্দশী তিথিতে পূজো-অর্চনা ও পক্ষকালব্যাপী মেলা হয়। এসময় পূণ্য সঞ্চয় ও মনস্কামনা পূরণার্থে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান হতে আগত তীর্থ যাত্রীদের পদচারণায় মন্দির প্রাঙ্গণ মুখরিত থাকে। মন্দিরে বিরল প্রজাতির একটি পারিজাত ফুলগাছ রয়েছে। ভক্তগণ প্রতিনিয়ত মনস্কামনা পূরণার্থে মানত করে গাছে সূতা বেঁধে রেখে যান এবং কামনা পূর্ণ হলে সূতা খুলে পূজা অর্পণ করেন।মূল মন্দিরের পেছনের দিকে দুটি পুকুর রয়েছে।সুমুদ্র পৃষ্ঠ হতে প্রায় ২৮০ ফুট উচ্চতায় পুকুর দুটির অবস্থান হলেও এর জল কখনই শুকায় না। জনশ্রুতি রয়েছে দু্টি পুকুরের মধ্যে একটিতে স্নান করলে সকল রোগ দূর হয়। মন্দিরের ব্যবস্থাপনা মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত বুকলেট হতে জানা যায় নবাব আলীবর্দি খাঁন, দেওয়ান ব্রজ কিশোর লাল কানুনগোর প্রতিনিধি দেওয়ান কালিচরণের নয় বত্সরের কিশোর শরত্ চন্দ্র কে সঙ্গে নিয়ে এই দ্বীপে আসেন এবং দ্বীপটি ক্রয় করেন।
পরবর্তীতে শরত্ চন্দ্র নাগা সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে এসে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি তার জমিদারীর সকল সম্পত্তি ১৮৭৬ সালে শ্রী শ্রী Adinath Mandir আদিনাথ মন্দির এর নামে দেবত্তর সম্পত্তি হিসাবে উইল করে দেন। আদিনাথ দ্বৈত ব্যবস্থাপনা পুরী এ্যাক্ট অনুযায়ী মোহন্ত শাসনে ছিল। পরবর্তীতে মোহন্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে ১৯১১ সন হতে এর ব্যবস্থাপনা সীতাকুন্ড স্রাইন কমিটির অধীনে ন্যাস্ত রয়েছে।যাতায়াত ও আবাসিক ব্যবস্থা কক্সবাজার জেলার কস্তুরী ঘাট অথবা ৬ নং ঘাট এলাকা হতে ট্রলার ও স্পিড বোট যোগে মহেশখালী যাওয়া যায়। ট্রলারে প্রায় ১ ঘণ্টা ও স্পিড বোটে প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগে। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রলার ও স্পিড বোট পাওয়া যায়।এছাড়া কক্সবাজার জেলাধীন চকরিয়া উপজেলা সদর হতে ট্যাক্সি অথবা ব্যক্তিগত গাড়িযোগেও মহেশখালী যাওয়া যায়। মন্দিরে তীর্থ যাত্রীদের জন্য থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া মহেশখালীতে মোটামুটি মানের থাকার হোটেল আছে। তবে একটু উন্নত পরিবেশে থাকতে চাইলে কক্সবাজার অথবা চকরিয়াতে থাকা যেতে পারে।
মহেশখালীর ইতিহাসের সাথে ‘নাথ’ সম্প্রদায়ের যোগ আছে বলে অনেকে মনে করেন। উল্লেখ্য নাথ সম্প্রদায়ের প্রথম গুরু মীন নাথের শিষ্য, গোরক্ষ নাথ-এর আবির্ভাব কাল হিসাবে একাদশ শতাব্দী বিবেচনা করা হয়। তাঁর রচিত গ্রন্থ গোরক্ষ বিজয প্রকাশিত হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে। নাথ সম্প্রদায়ের চারজন সিদ্ধগুরু মীননাথ, গোরক্ষনাথ, হাড়িপা এবং কাহ্নপার প্রভাব বাংলাদেশের অনেকস্থানে ছাড়িয়ে পড়েছিল। ধারণা করা হয়, নাথ সম্প্রদায়ের কোনো শিষ্য মহেশখালীতে এই মন্দির নির্মাণ করেছিল। বাংলাদেশের দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, বগুড়া অঞ্চলে গোরক্ষনাথের শিব মন্দিরে মতো, বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। উল্লেখ্য মন্দিরের অনতিদুর একটি বাজারের নাম গোরকঘাটা বাজার। এই নামের সাথে ‘গোরক্ষ’ নামের মিল পাওয়া যায়। আদিনাথ মন্দিরের লোক কাহিনীতে নেপাল রাজা, নুর মোহাম্মদ সিকদারের উল্লেখ আছে। গোরক্ষ বিজয়েও কবীন্দ্র দাস, শ্যামদাস, ভীমদাসসহ ফয়জুল্লাহ, সুকুর মুহাম্মদ প্রভৃতি মুসলমানের নামও পাওয়া যায়। বর্তমানে এই মন্দির কমপ্লেক্সে আছে একটি মসজিদ ও একটি রাখাইন বৌদ্ধ বিহার। তাই অনেকে মন্দিরটিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক মনে করেন। প্রতিবছর শিব চতুর্দশী উপলক্ষে হাজার হাজার দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে এ মন্দিরে। এ উপলক্ষে ১০/১৫ দিন মেলা বসে।