পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Bandopadhyay) একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ যিনি ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের অষ্টম মুখ্যমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করছেন। Mamata Bandopadhyay মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের প্রাক্তন রেলমন্ত্রীও ছিলেন একসময়। তাঁর হাত ধরেই সর্ব ভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক দলটির প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি ‘দিদি’ নামেই বেশি পরিচিত। ১৯৫৫ সালে ৫ জানুয়ারি কলকাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম প্রমীলেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম গায়ত্রী দেবী।
তাঁর মাত্র সতেরো বছর বয়সেই বাবার মৃত্যু হয়। ১৯৭০ সালে দেশবন্ধু শিশু শিক্ষালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে তিনি যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক ইতিহাস নিয়ে তাঁর স্নাতকোত্তর করেন। তিনি শ্রীশিক্ষায়তন কলেজ থেকে শিক্ষা তত্ত্ব (education) নিয়ে এবং যোগেশচন্দ্র কলেজ থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। মাত্র পনেরো বছর থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।যোগমায়া দেবী কলেজে পড়াকালীন তিনি ছাত্র পরিষদ গঠন করেন। তিনি প্রথম থেকেই সর্বভারতীয় কংগ্রেস পার্টির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালে প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জয়প্রকাশ নারায়ণের গাড়ির উপরে উঠে প্রতিবাদ জানানোর জন্য তিনি সংবাদমাধ্যমের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এরপর থেকে খুব দ্রুত বেগে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান হতে থাকে।
১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গের মহিলা কংগ্রেস পার্টির সাধারণ সম্পাদক (general secretary) ছিলেন। ১৯৮৪ সালে তিনি কলকাতার যাদবপুর কেন্দ্র থেকে সাধারণ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে জয়ী হন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় সংসদের অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। ১৯৮৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য মালিনী ভট্টাচার্যের কাছে তিনি এই আসনটি হারান এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্র থেকে জয়ী হন।এরপর পর পর তিনি ১৯৯৬ সালে, ১৯৯৮ সালে, ১৯৯৯ সালে, ২০০৪ সালে এবং ২০০৯ সালে সাধারণ নির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে এসেছেন। ১৯৯১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও তাঁকে মানব সম্পদ উন্নয়ন, ইয়ুথ অ্যাফেয়ার্স এন্ড স্পোর্টস (youth affairs and sports) এবং মহিলা ও শিশু বিকাশের জন্য কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে ক্রীড়া উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর মত বিরোধ হওয়ায় তিনি ক্রীড়া মন্ত্রীর দায়িত্ব ত্যাগ করেন।
১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে মমতা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী একটি মেয়ে ফেলানী বসাককে (যাকে সিপিআই(এম) ক্যাডাররা ধর্ষণ করেছিল বলে অভিযোগ ছিল) রাইটার্স বিল্ডিং-এ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাকে নিগৃহীত করার পরে গ্রেপ্তার এবং আটক করে। তিনি শপথ নিয়েছিলেন যে তিনি কেবল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঐ বিল্ডিংয়ে পুনরায় প্রবেশ করবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্য যুব কংগ্রেস ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই রাজ্যের কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের উদ্দেশ্যে প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করে। তাদের দাবি ছিল সিপিএমের “বৈজ্ঞানিক কারচুপি” বন্ধ করার জন্য ভোটারদের আইডি কার্ডকে ভোটের জন্য একমাত্র প্রয়োজনীয় দলিল বানানো উচিত। বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশের গুলিতে তেরো জন নিহত হয় এবং আরও অনেকে আহত হয়।
১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে Mamata Bandopadhyay মমতা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী একটি মেয়ে ফেলানী বসাককে (যাকে সিপিআই(এম) ক্যাডাররা ধর্ষণ করেছিল বলে অভিযোগ ছিল) রাইটার্স বিল্ডিং-এ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাকে নিগৃহীত করার পরে গ্রেপ্তার এবং আটক করে। তিনি শপথ নিয়েছিলেন যে তিনি কেবল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঐ বিল্ডিংয়ে পুনরায় প্রবেশ করবেন। Mamata Bandopadhyay মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্য যুব কংগ্রেস ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই রাজ্যের কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের উদ্দেশ্যে প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করে। তাদের দাবি ছিল সিপিএমের “বৈজ্ঞানিক কারচুপি” বন্ধ করার জন্য ভোটারদের আইডি কার্ডকে ভোটের জন্য একমাত্র প্রয়োজনীয় দলিল বানানো উচিত। বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশের গুলিতে তেরো জন নিহত হয় এবং আরও অনেকে আহত হয়।
এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন “পুলিশ ভাল কাজ করেছে। ২০১৪ সালের তদন্তের সময়, ওড়িশা হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) সুশান্ত চ্যাটার্জি পুলিশের প্রতিক্রিয়াকে “উস্কানিবিহীন এবং অসাংবিধানিক” বলে বর্ণনা করেছিলেন। বিচারপতি চ্যাটার্জি বলেন, “কমিশন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে ঘটনাটি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের চেয়েও খারাপ।১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে লোকসভার ওয়েলে বসে পড়েন তিনি। এই সময়ই সমাজবাদী পার্টি সাংসদ অমর সিংহের জামার কলার ধরে তার সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন মমতা। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লোকসভায় রেল বাজেট পেশের দিন পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বঞ্চনার প্রতিবাদে রেল বাজেট পেশ চলাকালীনই তদনীন্তন রেলমন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানের দিকে নিজের শাল নিক্ষেপ করেন তিনি। পরে তিনি সাংসদ পদ থেকে ইস্তফাও দেন। কিন্তু লোকসভার তদনীন্তন অধ্যক্ষ পি. এ. সাংমা তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাখ্যান করে তাকে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দেন।
পরে সন্তোষমোহন দেবের মধ্যস্থতায় তিনি ফিরে আসেন। এরপর ১৯৯৭ সালে প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট সৌমেন মিত্রের সাথে বিরোধ হওয়ায় Mamata Bandopadhyay মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং তাঁর নিজস্ব নতুন দল সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস All India Trinamool Congress তৈরি করেন। এই কাজে তার অন্যতম সহকারি ছিলেন মুকুল রায়। খুব তাড়াতাড়ি তৃণমূল কংগ্রেস পার্টি বাংলার শাসক দল কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান বিরোধী দল হয়ে দাঁড়ায়। অনতিকাল পরেই তার দল দীর্ঘকাল বামফ্রন্ট-শাসিত পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধীশক্তিতে পরিণত হয়। ১৯৯৮ সালের ১১ ডিসেম্বর সমাজবাদী পার্টি সাংসদ দারোগা প্রসাদ সরোজ “মহিলা সংরক্ষণ বিলের” বিরোধিতায় লোকসভার ওয়ালে নেমে গেলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার জামার কলার ধরে টানতে টানতে তাকে ওয়েলের বাইরে বের করে দেন। এই ঘটনায় কিছু বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়।
১৯৯৯ সালে তিনি ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স(NDA)’ সরকারের সাথে যোগ দেন এবং প্রথমবারের জন্য Mamata Bandopadhyay ভারতের রেলমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০০ সাল অব্দি তিনি রেলমন্ত্রী ছিলেন। ২০০০ সালে তিনি প্রথম রেল বাজেট (rail budget) পেশ করেন। সেখানে তিনি পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়া অনেক প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে সক্ষম হন।তিনি নতুন দিল্লি – শিয়ালদা রাজধানী এক্সপ্রেস চালু করেন। এছাড়াও তিনি পশ্চিমবঙ্গের জন্য আরও বেশকিছু ট্রেন চালু করেন যেমন হাওড়া -পুরুলিয়া রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস, শিয়ালদা- নিউ জলপাইগুড়ি পদাতিক এক্সপ্রেস, শালিমার- আদ্রা আরণ্যক এক্সপ্রেস, শিয়ালদা- আজমির সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস এবং শিয়ালদা- অমৃতসর অকাল তখ্ত সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ইত্যাদি।
এছাড়াও তিনি পর্যটক আকর্ষণ করার জন্য দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের ( Darjeeling Himalayan Railway) উন্নয়ন করেন। তাঁরই উদ্যোগে ২০০০ সাল থেকে ২০০১ সালের মধ্যে সারাদেশে উনিশটি নতুন ট্রেন চালু করা হয়। পেট্রোলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে তিনি এবং অজিত কুমার পাঁজা মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০১ সালে তাঁর নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস সর্বভারতীয় কংগ্রেস পার্টির সাথে জোট বাঁধে। ২০০১ সালের প্রথম দিকে একটি রাজনৈতিক মতবিরোধের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এনডিএ-র সঙ্গে সম্পর্ক সাময়িকভাবে ত্যাগ করেন। ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তার দল জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়।তবে সেবার এই জোট বামফ্রন্টকে পরাজিত করতে অসমর্থ হয়েছিল। ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি আবার এনডিএ-তে ফিরে আসেন এবং কয়লা ও খনি মন্ত্রকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তার পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত একমাত্র তৃণমূল সাংসদ। ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের শিল্পনীতির বিরোধিতা করেন মমতা। ইন্দোনেশিয়া-ভিত্তিক সালিম গোষ্ঠীর মালিক বেনি সান্তোসো পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে এলে সরকার তাকে হাওড়ার একটি কৃষিজমি কারখানা স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রদান করে। এর পরই রাজ্যে বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়।
প্রবল বর্ষণের মধ্যেই সান্তোসোর আগমনের প্রতিবাদ জানাতে মমতা ও তার সমর্থকেরা তাজ হোটেলের সামনে জড়ো হন। পুলিশ তাদের হটিয়ে দিলে তারা পরে সান্তোসোর কনভয় ধাওয়াও করেন। উল্লেখ্য, কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচি এড়াবার জন্য সরকার সান্তোসোদের কর্মসূচি তিন ঘণ্টা এগিয়ে এনেছিল। ২০০৫ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তীব্র রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েন। এই বছর পৌরনির্বাচনে তার দল কলকাতা পৌরসংস্থার ক্ষমতা হারায়। কলকাতার তদনীন্তন মহানাগরিক সুব্রত মুখোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস ত্যাগ করে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন।২০০৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনেও তৃণমূল কংগ্রেস বড়োসড়ো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এই নির্বাচনে পূর্বের বিজিত আসনগুলির অর্ধেকেই দল পরাজিত হয়েছিল। ২০০৬ সালের ৪ আগস্ট লোকসভার তৎকালীন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় তার আনা একটি মুলতুবি প্রস্তাব বাতিল করে দেওয়ার পর মমতা লোকসভার উপাধ্যক্ষ চরণজিৎ সিংহ অটওয়ালের কাছে তার ইস্তফাপত্র পাঠান। পশ্চিমবঙ্গে বেআইনি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে এই মুলতুবি প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়েছিল।
কিন্তু মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপনের সঠিক নিয়মাবলি না মানায় অধ্যক্ষ এটি বাতিল করে দিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো প্রকল্পের বিরুদ্ধে একটি জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে তাকে জোর করে বাধা দেওয়া হয়। মমতা পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিধানসভাতেই সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে তিনি ১২ ঘণ্টা বাংলা বন্ধও ঘোষণা করেন। তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়করা বিধানসভায় ভাঙচুর চালান পথ অবরোধ করেন এবং অনেক জায়গায় যানবাহনে অগ্নিসংযোগও করা হয়।এরপর ২০০৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর একটি বড়োসড়ো ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। সরকার কর্তৃক বলপূর্বক কৃষিজমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে ৪ ডিসেম্বরে মমতা কলকাতায় ঐতিহাসিক ২৬ দিনের অনশন শুরু করেন। তার স্বাস্থ্যের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ. পি. জে. আবদুল কালাম সমস্যাটি সমাধানের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সঙ্গে কথা বলেন।”জীবন মূল্যবান” এই বলে কালাম মমতার কাছে তার অনশন প্রত্যাহারের আবেদন করেন। মনমোহন সিংয়ের একটি চিঠি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর কাছে ফ্যাক্স করা হয় এবং তারপর তা অবিলম্বে মমতার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।চিঠি পাওয়ার পর অবশেষে মমতা ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে তার অনশন ভাঙেন।
নন্দীগ্রাম গণহত্যা পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে একটি কেমিক্যাল হাব স্থাপন করতে চাইলে তমলুকের সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠের নেতৃত্বাধীন হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ এই অঞ্চলে জমি অধিগ্রহণের নোটিশ জারি করেন। তৃণমূল কংগ্রেস এর বিরোধিতা করে। মুখ্যমন্ত্রী নোটিশটি বাতিল ঘোষণা করেন। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ কৃষকদের ছয়মাসব্যাপী অবরোধ তুলতে পুলিশ তাদের উপর গুলিচালনা করলে চোদ্দো জনের মৃত্যু ঘটে। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে স্থানীয় কৃষকদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করে। এরপর রাজনৈতিক সংঘর্ষে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। নন্দীগ্রামে তার নিজের দলের কর্মীদের দ্বারা কৃত হিংসাকে সমর্থন করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন “তাদের (বিরোধীদের) একই মুদ্রায় পরিশোধ করা হয়েছে। নন্দীগ্রাম গণহত্যার প্রতিবাদে কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের একটি বৃহৎ অংশ বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। নন্দীগ্রাম আক্রমণের সময় সিপিআই(এম) ক্যাডাররা ৩০০ জন মহিলা ও মেয়েকে শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ ছিল৷
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও তদনীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাতিলকে লেখা চিঠিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিআই(এম)-এর বিরুদ্ধে নন্দীগ্রামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগ আনেন। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নন্দীগ্রামের কেমিক্যাল হাব প্রকল্পটি স্থগিত করতে বাধ্য হন। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে মমতা প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হন। উর্বর কৃষিজমিতে শিল্পের বিরোধিতা ও পরিবেশ রক্ষার যে বার্তা নন্দীগ্রামের আন্দোলন প্রদান করে তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস অত্যন্ত ভাল ফল করে। পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস একাই ১৯টি আসনে জয়লাভ করে। তৃণমূলের জোটসঙ্গী জাতীয় কংগ্রেস ৬টি আসনে ও এসইউসিআই(সি) একটি আসনে জয়লাভ করে। তৃণমূল কংগ্রেস জোট মোট ২৬টি আসনে জয়লাভ করে।
অন্যদিকে বামফ্রন্ট ১৫টি ও বিজেপি একটি আসন পায়। তৃণমূল কংগ্রেসের ১৯ জন সাংসদের মধ্যে মহিলা সাংসদের সংখ্যা পাঁচ। উল্লেখ্য, তৃণমূল কংগ্রেস ভারতে মহিলা সংরক্ষণ বিলের প্রবল সমর্থক। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীরা রাজ্যের ৩৩ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের ইতিহাসে প্রথম শাসকদলকে লোকসভা নির্বাচনে পরাজিত করে। ২০০৯ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয়বারের জন্য রেলমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। রেলমন্ত্রী হিসেবে তিনি এবারও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন যার মধ্যে অন্যতম- দুরন্ত এক্সপ্রেসের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া, শুধু মহিলাদের জন্য ট্রেন চালু করা এবং বড় বড় শহরগুলিকে যুক্ত করার জন্য প্রচুর সংখ্যক ট্রেন চালু করে। এছাড়াও তিনি কলকাতা মেট্রো রেলের (Kolkata Metro Rail) উন্নয়নও করেন। ২০১০ সালে নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস কলকাতা পুরসভা থেকে জয়ী হয়। এর পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেস বিধাননগর পুরসভা থেকেও জয়ী হয়। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে ২২৭টি আসনে (এককভাবে ১৮৪টি আসনে) জয়লাভ করে (মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে) সরকার গঠন করে।
২০ মে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথমেই তিনি সিঙ্গুরের চাষীদের তাঁদের থেকে ৪০০ একর জমি ফিরিয়ে দেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ তে, বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ সহ অন্যান্য ইস্যুতে সংঘাত ঘটায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট বা ইউপিএ-এর থেকে সমর্থন তুলে নেন। ২০১৪ সালে ভারতের লোকসভার নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবে লড়ে পশ্চিমবঙ্গের ৩৪টি লোকসভা আসনে জয়লাভ করে। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবে ২১১টি আসনে জয়লাভ করে (মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে) সরকার গঠন করে। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীরূপে পুনরায় শপথ পাঠ করেন।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি বাংলার স্বনামধন্য শিল্পীদের বঙ্গবিভূষণ এবং বঙ্গভূষণ সম্মান দিয়ে সম্মানিত করেন।পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ি অঞ্চলে গোর্খাল্যান্ডে (Gorkha Land) সংক্রান্ত সমস্যা এবং জঙ্গলমহলের মাওবাদীদের সমস্যার তিনি খুব তাড়াতাড়ি সমাধান করেন। এছাড়াও তিনি স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। তিনি শিক্ষকদের সঠিক সময়ে বেতন দেওয়া এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ঠিক সময় পেনশন (pension) দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।কলকাতার নতুন মেট্রো স্টেশনের নাম তিনি বাঙালি মনীষীদের নামে রাখেন যেমন মাস্টারদা সূর্যসেন, কবি সুভাষ, কবি নজরুল ইত্যাদি। বাংলায় তিনি প্রচুর নতুন সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করে থাকেন। এর পাশাপাশি তিনি লেখালেখি করেন এবং ছবি আঁকেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আসার পর ধর্মঘটের সংস্কৃতি বন্ধ করেন। এছাড়াও তিনি পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দেন এবং লোডশেডিং (load shading) অনেকটাই বন্ধ করতে সক্ষম হন।
২০১২ সালে টাইমস ম্যাগাজিন (Times Magazine) সেই বছরের বিশ্বের একশো জন প্রভাবশালী মানুষদের মধ্যে তাঁকে স্থান দেয়। সেই বছরই ব্লুমবার্গ মারকেটস (Bloomberg Markets Magazine) ম্যাগাজিন তাঁকে পৃথিবীর পঞ্চাশ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে স্থান দেয়। ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজি (Kalinga Institute of Industrial Technology) থেকে তাঁকে ডক্টরেট (Doctorate) উপাধি দেওয়া হয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে ডিলিট (D.Lit) সম্মানে সম্মানিত করা হয়।দেশের তাবড় নেতাদের সম্পত্তি যখন ক্রমশই বাড়ছে, বারবারই আর্থিক তছরূপের দায়ে শ্রীঘরের ঘানি টানতে হচ্ছে নামকরা নেতাদের, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পত্তির পরিমাণ নাকি কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। এটাই সত্যি। ২০২১ সালে নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া তথ্য অন্তত তাই বলছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে হলফনামা পেশ করেছিলেন তার সঙ্গে ২০২১ সালের হলফনামার তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি সম্পদ কমেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
তবে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া তথ্য জানাচ্ছে দেশের মধ্যে সবথেকে কম সম্পদশালী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২১ সালে নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া তথ্য অন্তত তাই বলছে।মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোট সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছেন ১৬.৭২ লক্ষ টাকার যা ২০১৬ সালের হলফনামায় ছিল ৩০,৪৫,০১৩ টাকা। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর সম্পদ কমেছে প্রায় ১৩ লক্ষ ৭৩ হাজার টাকার বেশি। ২০২১ সালে পেশ করা হলফনামায় অনুযায়ী বর্তমানে Mamata Bandopadhyay মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে নগদ রয়েছে ৬৯,২৫৫ টাকা।ব্যাঙ্কে থাকা অর্থের পরিমাণ ১৩.৫৩ লক্ষ টাকা। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ এবং গয়নার পরিমান যথাক্রমে ১৮,৪৯০ টাকা এবং ৪৩,৮৩৭ টাকা। ২০১৬ সালের মুখ্যমন্ত্রীর হলফনামা অনুযায়ী হাতে থাকা নগদের পরিমাণ ছিল ১৮,৪৩৬ টাকা। তিনটি ব্যাঙ্কে রাখা অর্থের পরিমাণ ছিল ২৭ লক্ষ ৬১ হাজার ৪৩১ টাকা।বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৪৯০ টাকা।
গয়নার ক্ষেত্রে মোট বিনিয়োগ ছিল ২৬ হাজার ৩৮০ টাকা। পাশাপাশি অন্যান্য সম্পত্তির পরিমাণ ছিল টাকার হিসেবে ২ লক্ষ ১৫ হাজার ৮৮ টাকা। ২০২১ সালের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের স্লোগান ছিল ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও হেরেছেন তাঁর আসন নন্দিগ্রামে। তিনি হেরেছেন বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে। মমতা হেরে গেলেও তাঁর দল মোটের হিসেবে পূর্বের থেকে ২ টি আসনে জয় পেয়েছে অর্থাৎ ২০২১ সালের নির্বাচনে তৃণমূল পেল ২১৩ টি আসন।নিজের আসনে হারলেও সংবিধান অনুযায়ী Mamata Bandopadhyay মমতার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পান মমতা। যা হবার তাই হয়েছে; Mamata Bandopadhyay মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয়াবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মে ২০, ২০২১ তারিখ। মে ৩, ২০২১ থেকে মে ৫, ২০২১ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। মুখ্যমন্ত্রী পদে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থাকতে হলে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে ৫৮ হাজার ৮৩২ ভোটের ব্যবধানে জয় পান।