হিন্দু সংস্কৃতিতে তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব হল Dev Deepawali দেব দীপাবলি । কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে সাধারণভাবে হিন্দুরা পালন করে থাকেন দীপাবলি উৎসব যাকে বাঙালিরা চেনে কালীপূজা নামে। দীপাবলি মানেই দীপের উৎসব অর্থাৎ আলোর উৎসব। হাজার হাজার প্রদীপের আলোয় ভরে ওঠে এই দিন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দীপাবলিতে বহু ধরনের আতসবাজি পোড়ানো হয়। বাঙালিরা কালীপূজায় দেবী কালীর আরাধনা করে থাকেন। আর ঠিক এর পনেরো দিন পরেই কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে বিশেষত বারাণসীতে পালন করা হয় Dev Deepawali দেব দীপাবলি।
দীপাবলি আর এই Dev Deepawali দেব দীপাবলির পালনের প্রকৃতি কিছুটা এক হলেও এর পটভূমি একেবারেই ভিন্ন। আসুন জেনে নিই Dev Deepawali দেব দীপাবলির আরো কিছু তথ্য। ‘দীপাবলি’ কথার আক্ষরিক অর্থ হল আলোর উৎসব। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ‘দেব দীপাবলি’ কথার আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় দেবতাদের আলোর উৎসব। উত্তরপ্রদেশের Varanasi বারাণসীর ঘাটে প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমায় এই পবিত্র উৎসবটি পালিত হয়। ইংরেজি ক্যালেণ্ডারের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে দেব দীপাবলি পালন করা হয়। বারাণসীর গঙ্গার ঘাটগুলি আলোয় সেজে ওঠে এই দিনে। দীপাবলির ঠিক পনেরো দিন পরে বারাণসীর একেবারে দক্ষিণ দিকের রবিদাস ঘাট থেকে শুরু করে রাজঘাট পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে, সহস্র প্রদীপের আলোয়, পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণে এক মায়াময় পরিবেশ রচিত হয়।
এই দিনে মাটির জ্বলন্ত প্রদীপ গঙ্গায় ভাসিয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানায় ভক্তরা। লোকের বিশ্বাস, এই দিনেই নাকি স্বর্গলোক থেকে দেবতারা নেমে আসেন মর্ত্যে গঙ্গায় পুণ্যস্নান করবেন বলে। এই দেব দীপাবলি যদিও ‘ত্রিপুর পূর্ণিমা স্নান’ নামেও পরিচিত। ১৯৮৫ সালে বারাণসীর পঞ্চগঙ্গা ঘাটেই প্রথম দেব দীপাবলি উপলক্ষ্যে প্রদীপ জ্বালানো হয়। এই দিনে সমস্ত বাড়িতেই প্রদীপ দিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়, বাড়ির সদর দরজায় নানা প্রকার রঙে রঙিন আলপনা দেওয়া হয়। রাত্রে পোড়ানো হয় বিভিন্ন রকমের আতসবাজি।
তাছাড়া বারাণসীর অলিতে গলিতে দেবতাদের মূর্তি হাতে নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাও বেরোয় অনেকসময়। কার্তিক স্নান আর দীপদান এই দুটিই দেব দীপাবলির প্রধান আচার-সংস্কারের মধ্যে পড়ে। কার্তিক মাসের পুণ্য তিথিতে গঙ্গাস্নানকেই কার্তিক স্নান বলা হয়। সন্ধ্যেবেলায় প্রদীপের সাহায্যে গঙ্গায় আরতি করার নাম দীপদান। টানা পাঁচ দিন ধরে চলে এই উৎসব যার সূচনা হয় প্রবোধিনী একাদশীতে এবং কার্তিক পূর্ণিমার দিন শেষ হয়। ধর্মীয় আচার-সংস্কারের পাশাপাশি এই বিশেষ দিনে বারাণসী পুলিশ প্রশাসনের তরফে দশাশ্বমেধ ঘাট এবং রাজপ্রসাদ ঘাটে ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’র স্মারক হিসেবে নিহত শহীদদের স্মরণে গঙ্গায় প্রদীপ ভাসানো হয় এবং শহীদদের স্মরণ করা হয়।
‘গঙ্গা সেবা নিধি’ সংস্থা এই বিশেষ স্মৃতিতর্পণের অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে। পর্যটকদের কাছে এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গঙ্গায় প্রদীপ ভাসানোর পাশাপাশি এই দিন সুদৃশ্য ফানুশ আকাশে ওড়ানো হয়। মনে করা হয় এই দিনে শিব ত্রিপুরাসুরকে হত্যা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে পৌরাণিক কাহিনিগুলি থেকে জানা যায় যে আদিকালে তিন জন অসুর ভ্রাতা ছিলেন খুবই পরাক্রমী। তারা ব্রহ্মাকে তপস্যায় তুষ্ট করে তাঁর থেকে তিনটি অভেদ্য ও চলনশীল দূর্গ লাভ করেন। বিশ্বের যে কোনো জায়গায় এই দূর্গগুলি নিয়ে তারা চলে যেতে পারতেন।
এই তিন অসুরকে একত্রে ত্রিপুরাসুর বলা হতো। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ব্রহ্মা যখন শিবের দ্বারস্থ হন, ব্রহ্মা জানান কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই তিন দূর্গ আকাশে একত্রে মিলিত হবে। আর সেই কথা মতো শিবও ঐ মুহূর্তে একটি মাত্র তীর ছুঁড়ে ত্রিপুর দূর্গ ধ্বংস করেন। আর এই আনন্দেই নাকি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে আলোকমালা প্রজ্জ্বলিত করে উল্লসিত হয়ে উঠেছিলেন দেবগণ। এই দেবতাদের জয়ের আনন্দের দিনই দেব দীপাবলি নামে পরিচিতি পায়।
তবে অনেকে মনে করেন শিখদের ধর্মগুরু গুরু নানক এবং জৈনদের ধর্মগুরু আদিনাথ তীর্থঙ্করের জন্ম হয়েছিল এই দিনে আর সে কারণেই দেবতারা সর্বত্র আলোকসজ্জায় সজ্জিত করেন। সন্ধ্যেবেলায় আলোকিত ঘাটের আরতি গঙ্গাবঙ্গে নৌকায় চড়েও উপভোগ করেন পর্যটকরা। পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে পুরোহিতরা ঘাটের ধারে ধারে পূজা করেন, আরতি করেন। গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে মাথার উপর পূর্ণিমার চাঁদ, হাজারো আতস বাজির আলোক রোশনাইকে ঘিরে এক অমোঘ আবহাওয়া তৈরি হয় দেব দীপাবলির দিন। পাঁচ দিন ধরে চলে গঙ্গা মহোৎসব। শত-সহস্র পুণ্যার্থী এই দিনে বারাণসীর ঘাটে প্রদীপ ভাসানোর জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন।