ভাগীরথী নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত পূর্ব বর্ধমান জেলার ঐতিহাসিক জনপদ কালনা Kalna history In Bengali লোকমুখে ‘অম্বিকা কালনা’ নামেই অধিক প্রসিদ্ধ । দেবী কালীর আরেক রূপ অম্বা বা অম্বিকা দেবীর নামানুসারেই শহরের নাম Ambika Kalna অম্বিকা-কালনা । মধ্যযুগীয় প্রসিদ্ধ নদী-বন্দর গুলির মধ্যে অন্যতম এই জনপদটি প্রাচীনকাল থেকেই শিল্প ও বাণিজ্যে সমৃদ্ধ। কালনায় দর্শনীয় স্থান প্রচুর। এই শীতের মরসুমে যে কোনও সপ্তাহান্তে ঘুরে দেখে আসতে পারেন টেরাকোটার অপূ্র্ব স্থাপত্যে সমৃদ্ধ এই প্রাচীন জনপদটি । কোনও এক শীতের ভোরে হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির নীচে জমাতেয়েত আর তারপর টিকিট কাউন্টার থেকে হাওড়া-কাটোয়া লোকালের টিকিট কেটে চড়ে বসলেই হল, মোটামুটি ৩ ঘন্টায় পৌঁছে যাবেন Ambika Kalna অম্বিকা কালনা স্টেশনে। শিয়ালদহ থেকে যেতে চাইলে কাটোয়া-শিয়ালদহ লোকালে যেতে পারেন। নামতে হবে Ambika Kalna অম্বিকা-কালনা স্টেশনে ।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে এই ঘন্টা তিনেকের সফরে দেখা পেতে পারে কাঁসার বগি থালায় ক্ষীরমোহনের পসরা সাজিয়ে ফেরি করতে আসা মিষ্টি বিক্রেতার কিংবা শালপাতার ডোঙায় করে গরম সিঙ্গারা ফেরি করতে আসা হকারের। ট্রেনে না গিয়ে গাড়িতে গেলে এই স্বাদের আস্বাদন সম্ভব নয়। অম্বিকা-কালনার রেলস্টেশন থেকে বেরিয়েই পেয়ে যাবেন টোটো-রিক্সা। তবে অনেক গুলো জায়গা একসাথে ঘুরতে চাইলে টোটো রিজার্ভ করে নেওয়াই সুবিধে। পুজো দেওয়ার হলে সকাল সকাল চলে যেতে পারেন সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে। তবে যদি দেবীর অন্নভোগ প্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করতে চান তাহলে হাতে একটা দিন বেশি সময় নিয়ে আসতে হবে । কতজন প্রসাদ পেতে চান সেটা আগের দিন জানিয়ে সেই হিসেবে মূল্য ধরে দিতে হয় । মালা মিষ্টি পূজার ডালা কিনে পূজা দিতে চাইলে তার ব্যবস্থাও রয়েছে । মন্দিরের মূল ফটকের দু’ধারে রয়েছে পূজা সামগ্রীর দোকান , সেখানে পাবেন মন্ডা, গুজিয়া, লাড্ডু, প্যাঁড়া, দানাদার, নিকুতি প্রভৃতি শুকনো মিষ্টি । ডালা কিনলে সে দোকানে জুতো খুলে পুজো দিতে যাওয়ার সুবিধাও আছে ।
জনশ্রুতি অনুসারে, বহু কাল আগে মন্দির-সংলগ্ন কালনা অঞ্চলে একটি জলাশয়ের পাড়ে এক বটগাছতলায় কুলার উপরে জমাটবদ্ধ অবস্থায় একটি ঘট খুঁজে পান কালীপদঅভিলাষী ঋষি অম্বরীশ বা অম্বু ঋষি। সে সময় ওই অঞ্চল ছিল জঙ্গলাকীর্ণ , কিছুদূরেই শ্মশান। অনেকে মনে করেন, জনমানবহীন এই জঙ্গলে পূজিতা মাতৃকা-ঘট হয়তবা ডাকাদের দ্বারাই পূজা পেতেন। পুকুরের পাড়ে খুঁজে পাওয়া এই ঘট প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতে শুরু করেন অম্বু ঋষি। তাঁর নামানুসারেই এই দেবী অম্বিকা এবং ওই জলাশয়টি ক্রমে অম্বিকাপুকুর নামে লোকমুখে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তিনি সেই সময়ে বর্তমান মন্দিরের স্থানে অবস্থিত বটগাছের তলায় ওই ঘট প্রতিষ্ঠা করে সাধনা করতেন ও পরে সিদ্ধিলাভ করেন।
তখন কোনও দেবীমূর্তি ছিল না। পাঁচ পুরুষ গুরু-শিষ্য পরম্পরায় ওই ভাবেই সেবাকার্য চলে। স্থানীয় ভক্তদের বক্তব্য অনুসারে বলা হয়, শেষ সাধক ঈশ্বরীশ দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মূর্তি তৈরি করান। নিমগাছের একটি কাষ্ঠখণ্ডেই তৈরি করানো হয় মূর্তি । ছোট বহরকুলির গাঙ্গুলীদের পুকুড়পাড়ে যে তিনটি নিমগাছ ছিল, তার মাঝেরটি নিয়ে এসে কলকাতার নিমতলার এক দারুশিল্পীর দ্বারা মূর্তি নির্মাণ করানো হয় এবং পঞ্চমুন্ডির আসনের উপর প্রতিষ্ঠা করে পূজারম্ভ হয়। সে সময় ওই মূর্তির ঠিক পিছনেই ছিল গঙ্গা ও শ্মশান। মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় তারও অনেক পরে। মন্দিরগাত্রে খোদিত ফলকটিতে মা অম্বিকাকে সিদ্ধেশ্বরী বলে উল্লেখ করা আছে।
কালনা সিদ্ধেশ্বরী কালীর মন্দিরটি আনুমানিক ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের রাজা চিত্রসেনের আমলে তৈরি হয়। সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরটি বাংলার নিজস্ব দেউলরীতিতে নির্মিত হয়েছে। থাম বা খিলানের উপর দুটি, পাশাপাশি চাল সহযোগে জোড়বাংলা শৈলীতে নির্মিত । মন্দিরের ভিতরের অংশটি গর্ভগৃহ এবং সম্মুখ ভাগ অর্ধমন্ডপরূপে ব্যবহৃত হয়। মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে গর্ভগৃহে পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রথমে পাঁচটি সিঁড়ি আছে। তারপর রয়েছে চারণ বা চাতাল এবং এর পর আরও ন’টি সিঁড়ি সরাসরি মূল মন্দিরে মিলিত হয়েছে। প্রাচীন তন্ত্র সাধনার পীঠস্থান হিসাবে অম্বিকা বা অম্বুয়া অঞ্চলের উল্লেখ আছে চৈতন্য-জীবনী গ্রন্থগুলিতেও।
বাংলার মন্দির-নির্মাণ শিল্পের অন্যতম নিদর্শন এই মন্দির। এক ঝলকে মন্দির দেখলে মনে হবে দু’টি খড়ের চালা একসঙ্গে জোড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহটি সমতলের থেকে কিছুটা উঁচুতেই অবস্থিত। কাছাকাছি বয়ে যাওয়া ভাগীরথীর বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতেই এমনটা করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। বর্তমানে মন্দিরে পূজিতা নিমকাঠ বা দারূব্রহ্ম নির্মিত দণ্ডায়মানা বামাকালী মূর্তিটিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এতে নেই কোনও সূক্ষ্ম কাজের ছোঁয়া। দারু-নির্মিত দেবী মূর্তির পদতলে আড়াআড়ি ভাবে শায়িত শবরূপী শিব , অর্থাৎ মাতৃকা মূর্তিটি বাম দিকে শিবের মাথা এবং ডান দিকে রয়েছে মহাদেবের পা ।
কিন্তু , দেবীমূর্তির সঙ্গে শিবমূর্তির কোন সামঞ্জস্য নেই। কারণ দেবী মূর্তিটি দারুনির্মিত হলেও শিবের মূর্তি দারু-নির্মিত নয়। যা থেকে অনুমান করা যায় শিবের মূর্তিটি পরে স্থাপন করা হয়েছে। কালক্রমে অম্বরীশের দ্বারা পূজিত সেই ঘট হয়ে গেছে গৌণ, তার স্থান হয়েছে দেবীমূর্তির ডান পাশের একটি কোণে। সারা বছর দেবীকে দর্শন করা গেলেও শুধুমাত্র কোজাগরী পূর্ণিমার পরের কৃষ্ণা পঞ্চমী থেকে কৃষ্ণা ত্রয়োদশী পর্যন্ত হয় দেবীর অঙ্গরাগ। এই সময়ে মা সিদ্ধেশ্বরী দিগম্বরী থাকেন বলে মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে। বছরের ওই নির্দিষ্ট সময় পুজো, ভোগ— সব কিছুই হয় মন্দিরের বাইরে। অঙ্গরাগের শেষ দিন, অর্থাৎ ভূত-চতুর্দশীর দিনে দেবীর দিগম্বরী বেশ জনসমক্ষে দেখানো হয় সন্ধ্যে সাতটা থেকে রাত বারোটা অবধি।
এরপর বস্ত্র পরিয়ে শুরু হয় পূজার প্রস্তুতি। বছরভর দেবীর পুজো হলেও কার্তিক অমাবস্যায় সিদ্ধেশ্বরীর পুজো ঘিরে মেতে ওঠেন পুরবাসীবৃন্দ। কালী পুজোর দিন দু’টি কালো ছাগ, দু’টি মেষ শাবক, চালকুমড়ো বা বলি কুমড়ো , আখ ও ডাব বলি দেয়ার রীতি এখানে বহুকাল থেকে প্রচলিত। এই বামাকালীর পূজা হয় তন্ত্রমতে। কথিত আছে, শ্মশানের পাশে পঞ্চমকারে পূজিতা এই বামা কালীর কাছে আগে নাকি নরবলিও হত। ডাকাতেরা কাটা মাথা ঝুলিয়ে দিয়ে যেত মন্দিরের সামনের খুঁটিতে। আর এই নরবলির প্রতীক স্বরূপ পরবর্তীকালে শুরু হয় ডাব বলি।
মন্দির সম্মন্ধে এই ধরণের আরও অনেক প্রচলিত কথা ও কাহিনি শোনা যায় স্থানীয় প্রবীন অধিবাসীবৃন্দের মুখে । আগে মন্দির-সংলগ্ন অম্বিকাপুকুরের জলেই হতো নিত্যপূজার নানা কাজ। এক সময়ে নাকি এই পুকুরের জলের মধ্যেই রাখা থাকত বিভিন্ন পূজা-পার্বণে ব্যবহৃত প্রচুর বাসনপত্র। গরিব মানুষরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেইসব বাসনপত্র বিয়ে বা অন্য কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করে, আবার সেগুলি জলের মধ্যে যথাস্থানে রেখে যেতেন।
ঋষি অম্বরিশের সিদ্ধপীঠের অধিশ্বরী এই সিদ্ধেশ্বরী কালী এ ভাবেই সুখে-দুখে কালনাবাসীর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন বলে অঞ্চলবাসীরা মনে করেন। তবে শুধু দেবী অম্বিকার মন্দিরই নয়, এ শহরে ছড়িয়ে রয়েছে স্থাপত্যের আরও অনেক নিদর্শন । দেখতে পারেন বর্ধমানের রাজা তেজচন্দ্র বাহাদুরের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত ১০৮টি শিবমন্দির, যা নবকৈলাশ নামে পরিচিত। এর ঠিক উল্টো দিকে রাজবাড়ি-কমপ্লেক্সের মধ্যেও আছে আরও অনেক মন্দির । ওই মন্দিরগুলি ছাড়াও শহরজুড়ে রয়েছে অসংখ্য মন্দির। সাধন কালীর সাধন কুঞ্জ, আনন্দময়ী কালী, সিদ্ধান্ত কালী, সত্যনাথের কালী, সাধক যোগানন্দের কালী মন্দির, সাধক কমলাকান্তের জন্মভিটে, ভবাপাগলার আশ্রম, চৈতন্য-পার্ষদ নিত্যানন্দ প্রভুর শ্রীপাঠ-সহ আরও অনেক দর্শনীয় স্থান ।
কালনা লক্ষ্মণপাড়ার ভট্টাচার্য পরিবারের বড় কালী তখন ব্রিটিশ রাজত্ব। ভাগীরথীর ঘাটে নিরঞ্জনের সময় মাপা হত প্রতিমার উচ্চতা। উচ্চতার নিরিখে সর্বোচ্চ লক্ষ্মণপাড়ার ভট্টাচার্য পরিবারের কালী প্রতিমাই বড় কালী নামে পরিচিতি পায়। উচ্চতার নিরিখে পরিচিতি পাওয়া বড়কালী, মেজকালী, সেজকালী রয়েছে এই কালনা শহরেই। ভট্টাচার্য পরিবারের বড়কালীর পুজো অন্তত ৪০০ বছরের প্রাচীন। পুজোয় বিভিন্ন সময়ে এসেছেন রামকৃষ্ণ, আনন্দময়ী মা, ওঙ্কারনাথের মতো প্রসিদ্ধ সাধক সাধিকারা। দেবীর কাছে প্রার্থনা করে বহু ভক্তের আশাপূরণ হওয়ায় আশাদেবী নামেও এই কালীর পরিচিতি রয়েছে।
পরিবারের পূর্বপুরুষ রামচন্দ্র ভট্টাচার্যের প্রপিতামহ এই পুজোর প্রচলন করেন। বড়কালীর নামেই শহরের ওই এলাকা ‘বড়কালীতলা’ হিসাবে পরিচিত। প্রাচীন এই পুজো ঘিরে রয়েছে নানা কাহিনি। আজও নিষ্ঠা ভরে মানা হয় পুজোর সমস্ত রীতি রেওয়াজ। দেবীর পায়ে নূপুর থাকার জন্য পরিবারের কারও নূপুর পরা বা নূপুর উপহার দেওয়া নিষিদ্ধ। কথিত আছে, একবার সেই রীতি ভেঙে পরিবারের এক গৃহকর্ত্রী বাড়ির পরিচারিকার মেয়েকে জন্মদিনে নূপুর উপহার দেওয়ায় ঘটে গিয়েছিল অঘটন। ওই দিনই সন্ধ্যাবেলায় সর্পদষ্ট হন তিনি। দেবীর কাছে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রাণ বাঁচে তাঁর।
৪০০ বছর আগে হোগলা পাতার ছাউনি দেওয়া মাটির মন্দিরে শুরু হয়েছিল পুজো। ওই সময়ে এলাকায় ছিল ঘন বন। আনাগোনা ছিল বাঘেরও। বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অমাবস্যার রাতে দু’টি মশাল জ্বালিয়ে রাখা হত পুজোর সময়। সেই রীতি মেনে আজও পুজোর সময় দু’টি মশাল জ্বালিয়ে রাখা হয়। রথের দিন সিঁদুর দান ও পাটা পুজোর পর শুরু হয়ে যায় প্রতিমা নির্মাণের কাজ। রীতি মেনে পুজোর সময় দু’জোড়া ঢাক বাজে মন্দিরে। পুজোর পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই। ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে শুরু হয় পুজো। পুজোর দিন পরিবারের মহিলা-পুরুষ সকলেই উপবাস করেন। দেবীর পুজোর ভোগেও রয়েছে বৈচিত্র। চিংড়ি সিদ্ধ করে বেসন দিয়ে ভেজে তা ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয়।
দেবীর স্বপ্নাদেশেই এমন বিশেষ ভোগের রেওয়াজ। এ ছাড়াও ভোগে খিচুড়ি, ফ্রায়েড রাইস, ৯ রকমের ভাজা, দু’রকমের তরকারি, মাছ নিবেদন করা হয়। দেবীর উচ্চতা নিয়ে রয়েছে এক অলৌকিক কাহিনি। একবার এলাকারই অন্য এক পরিবার বড়কালীর চেয়ে বেশি উচ্চতার প্রতিমা বানাবে বলে মাপ চুরি করে নিয়ে যায়। কিন্তু ভাগীরথীর ঘাটে বিসর্জনের সময়ে দেখা যায়, বড়কালীর উচ্চতাই সবথেকে বেশি। এই পুজোয় অংশ নেন লাগোয়া এলাকায় বসবাসকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনও। রীতি মেনে আজও মশাল জ্বালিয়ে প্রতিমার নিরঞ্জন হয়। পুরোনো সব রীতি মানা হলেও ভেঙেছে শুধু একটি রীতি। তা হল কাঁধে চাপিয়ে নিরঞ্জনের বদলে এখন ট্রলিতে চাপিয়েই প্রতিমার বিসর্জন হয়।
কালনা ধাত্রীগ্রামের চট্টোপাধ্যায় বাড়ির বুড়ো মা দক্ষিণ ধাত্রীগ্রামের বামুনপাড়ার এই বাড়ির পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গা-ছমছমে নরবলির গল্প। পুজোয় রয়েছে বেশ কিছু বিশেষত্বও। জনশ্রুতি অনুসারে, প্রায় ৩০০ বছর প্রাচীন এই দেবীর সামনে নরবলি দিত এলাকার ডাকাতের দল। পরে মহিষ বলির প্রথা ছিল। পরিবারের সদস্যরা জানান, তিন পুরুষ আগে দেবীর স্বপ্নাদেশে মহিষ বলির প্রথাও বন্ধ হয়ে যায়। বুড়ো মার ভোগের কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। দেবীর স্বপ্নাদেশ মেনে পরিবারের কালীদিঘির মাছেরই পদের ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। রুই মাছ ভাজার সঙ্গে ভোগে দেবীকে নিবেদন করা হয় ইলিশ মাছের টক, চিংড়ি মাছের ডালনা।
আগে মুগ, মটর, কলাই, অড়হড় ডালের খিচুড়ির ভোগ দেওয়া হত। আর আলাদা আলাদা ডালের আলাদা ভাবে খিচুড়ি রান্না করা হলেও বর্তমানে সব ডাল একসঙ্গে দিয়ে খিচুড়ি বানানো হয়। এ ছাড়া ভোগে থাকে ১৭ রকমের ভাজা, পোলাও এবং তরকারি। প্রাচীন রীতি মেনে দেবীর কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় আংটার সঙ্গে। এর কারণ হিসাবে পরিবারের সদস্য অলোক চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘এক বার দেখা যায় দেবী মন্দিরে নেই। পরে অন্য জায়গায় দেবীর হদিস মেলে। পরে এক পূর্বপুরুষকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে দেবী জানান, তাঁকে বেঁধে না রাখার জন্যই তিনি চলে গিয়েছিলেন। তার পর থেকেই পুজো শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ভাবে বেঁধে রাখার প্রথা চালু হয়।’
কালনা সাধক কমলাকান্ত ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে কালনা শহরের বিদ্যাবাগীশ পাড়ায় জন্ম কালী সাধক কমলাকান্তের। রামপ্রসাদের সমসাময়িক ছিলেন কমলাকান্ত। কিশোর বয়সে পিতৃ-মাতৃ বিয়োগের পর তিনি বর্ধমানে এক পিতৃশিষ্যের কাছে চলে যান। শাক্ত কবি হিসাবে কমলাকান্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। বর্ধমান মহারাজা তেজচন্দ্র ও প্রতাপচন্দ্রের গুরুদেব ছিলেন তিনি। বর্ধমান রাজ পরিবারের সভাপণ্ডিতও ছিলেন। বিদ্যাবাগীশপাড়ায় কমলাকান্তের জন্মভিটেটি দীর্ঘদিন অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকার পর স্থানীয় কিছু বাসিন্দা তা সংস্কারে উদ্যোগী হন। সেখানে থাকা কালীমূর্তির নিত্য পুজোও হয়। কালীপুজোর সময় জন্মভিটেতে নিষ্ঠার সঙ্গে কালীপুজোর আয়োজন করা হয়।
কালনা ভবাপাগলা কথা কতটা সরল করে বললে মনের কথাটা সবাই বুঝবে, তা খুব ভালো জানতেন কালী সাধক ভবাপাগলা। তাঁর রচিত শ্যামাসঙ্গীত ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাধনস্থল হিসাবে কালনাকেই বেছে নিয়েছিলেন এই সাধক। কালনা শহরের জাপটে রয়েছে ভবাপাগলার ভবানী মন্দির। একাধারে শাক্ত কবি ও অন্য দিকে শিল্পী এবং মাতৃসাধক হিসাবে পরিচিত ছিলেন ভবাপাগলা। তাঁর রচিত শ্যামাসঙ্গীত আজও কালী ভক্তদের মুখে মুখে ফেরে। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা কয়েক হাজার। বাংলাদেশের ঢাকা জেলার আমতা গ্রামে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ভবাপাগলার জন্ম। তাঁর নাম ছিল ভবেন্দ্র মোহন চৌধুরী।
ঢাকার সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। জনশ্রুতি অনুসারে, ১৪ বছর বয়সে মা কালীর দর্শন পান তিনি। বাল্য বয়সে তিনি প্রতিমা নিয়েই খেলা করতেন। ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে কিছু দিন কলকাতায় কাটানোর পরে চৈতন্যদেবের জন্মস্থান নবদ্বীপে যাওয়ার পথে কালনায় এসে তাঁর ভালো লেগে যায়। সাধন স্থল হিসাবে বেছে নেন কালনাকেই। তৈরি করেন ভবার ভবানী মন্দির। এই মন্দিরে বসেই তিনি লিখেছেন প্রচুর গান ও কবিতা। তাঁর রচিত সেই সমস্ত গান জায়গা করে নেয় মানুষের মনে। তৈরি হয় তাঁর বহু গুণমুগ্ধ ভক্ত। শুধু ভিন রাজ্য নয়, ভিন দেশেও ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর ভক্ত।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভবাপাগলা তাঁর কবিতা ও গানের মাধ্যমে লোক শিক্ষার কাজও করে গিয়েছেন। বেশ কিছু বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন এই সাধক। আলপনা, বেহালা বাজানো, সেলাই, অঙ্কন, হারমোনিয়াম বাজানো— সবেতেই পারদর্শী ছিলেন তিনি। তাঁর আঁকা ছবি ছড়িয়ে রয়েছে মন্দির জুড়ে। বাংলাদেশে খুব কম বাউল শিল্পীই আছেন যিনি ভবাপাগলার নাম শোনেননি। ভবাপাগলার ভক্তের তালিকায় রয়েছেন মহানায়ক উত্তম কুমার, মলিনা দেবী, গুরুদাস বন্দোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ বসু গুণমুগ্ধ ছিলেন ভবাপাগলার। বেশ কয়েকবার তিনি এসেছিলেন ভবার ভবানী মন্দিরে। তাঁর লেখা ‘মুক্তবেণীর উজানে’ ও ‘চলো মন রূপনগরে’— এই দু’টি উপন্যাসে ভবাপাগলার চরিত্র চিত্রন করেছেন।
ভবাপাগলার মন্দিরে বছরভর পুজো হয়। ভবাপাগলার আরাধ্য কালী মূর্তিটি কষ্টি পাথরের। কালীপুজোর দিন বিশেষ পুজো হলেও মহাপুজো অনুষ্ঠিত হয় বৈশাখ মাসের শেষ শনিবারে। কালীপুজোর দিন পুজোর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধ্যাবেলা শুরু হয় পুজো। রীতি মেনে কলা, শসা, আদা, আম ও কুমড়োর বলি হয়। ভবাপাগলা নিজে প্রাণীবলির ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। নিত্য পুজোয় ভবাপাগলা দেবীকে খিচুড়ি, মিষ্টি, ফলের ভোগ দিতেন। রীতি মেনে আজও নিত্য পুজোয় তেমনই ভোগ নিবেদন করা হয় দেবীকে। জনশ্রুতি আছে, রোগাক্রান্ত কাউকে ভবা স্পর্শ করলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠতেন। বাস্তববাদী ভবা ভক্তদের বলতেন, জন্মিলে মরিতে হবে। নিজের জীবদ্দশাতেই মন্দিরের সামনে বানিয়ে রেখেছিলেন সমাধি। নির্দেশ দিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর যেন তাঁকে সেখানেই সমাধিস্থ করা হয়। শিশুদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন এই সাধক। শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য মন্দির জুড়ে গড়ে তুলেছিলেন পশুশালা। আজ অবশ্য আর তা নেই।
কালনা ভান্ডারটিকুরির পণ্ডিতের কালীপুজো এই এলাকায় সবুজের অভাব ছিল। তাই সবুজায়নের উদ্দেশ্যে বৃক্ষকে দেবী জ্ঞানে পুজোর প্রচলন হয়। বৃক্ষ কালীরূপে পূজিত হয় ভান্ডারটিকুরির পণ্ডিত বাড়ির পুজোয়। বেল, অশ্বত্থ, বট, নিম আর অশোক— এই পাঁচটি গাছের পঞ্চবটী আসনে এই বাড়ির পুজো হয়। পরিবারের পূর্বপুরুষ কালীসাধক বিনোদ বিহারী ভট্টাচার্য গঙ্গার অববাহিকায় কালীর সাধনা করতেন। তিনিই এমন পঞ্চবটী আসনে পুজোর প্রচলন করেছিলেন। পুজো ঘিরে অলৌকিক কাহিনিও রয়েছে। পঞ্চবটীর আসনে বসে ঘটে দেবীর পুজো হলেও একবার মূর্তি গড়ে পুজোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সে বারই ঘটে যায় অঘটন। জনশ্রুতি অনুসারে, কালীপুজোর দিনই অকাল মৃত্যু হয়েছিল পরিবারের এক সদস্যের। সকলে ভেবে নেন, বৃক্ষের বদলে প্রতিমা গড়ে পুজো করায় রুষ্ট হয়েছেন দেবী। সেই কারণেই ঘটেছে এমন অঘটন। তার পর আর কখনও প্রতিমা গড়ে পুজোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পুজোর দিন যজ্ঞের আয়োজন করা হয়। সেই যজ্ঞের সময় পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কেউ থাকতে পারেন না। যজ্ঞের প্রয়োজনীয় কাঠ ওই পঞ্চ বৃক্ষ থেকেই নেওয়া হয়। দেবীকে ভোগে পঞ্চব্যঞ্জন ছাড়াও নিবেদন করা হয় খিচুড়ি ও পায়েস। এ ছাড়া তামার পাত্রে ডাবের জল আর সিদ্ধিও নিবেদন করা হয় দেবীকে।
কালনা কি জন্য বিখ্যাত? কালনা, যার বানান অম্বিকা কালনা, বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার জন্য পৌরসভা কেন্দ্র এবং সরকারের আসন। রাজবাড়ির জন্য বিখ্যাত হওয়ার পাশাপাশি, এই শহরটি তার 108টি শিব মন্দিরের জন্যও বিখ্যাত। এই শহরের নামটি হিন্দু দেবী কালী থেকে এসেছে, যাকে মা অম্বিকাও বলা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের কালনা কোন নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে? কালনা, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি শহর এবং একটি পৌরসভা হুগলি (বা ‘নিম্ন গঙ্গা’) নদীর তীরে অবস্থিত যার অর্থ গঙ্গা নদী ক্রুজের মাধ্যমে এলাকাটি ঘুরে দেখার প্রচুর সুযোগ রয়েছে।
আরো পড়ুন পশ্চিমবঙ্গ জীবনী মন্দির দর্শন ইতিহাস জেলা শহর লোকসভা বিধানসভা পৌরসভা ব্লক থানা গ্রাম পঞ্চায়েত কালীপূজা যোগ ব্যায়াম পুজা পাঠ দুর্গাপুজো ব্রত কথা মিউচুয়াল ফান্ড জ্যোতিষশাস্ত্র ভ্রমণ বার্ষিক রাশিফল মাসিক রাশিফল সাপ্তাহিক রাশিফল আজকের রাশিফল চানক্যের নীতি বাংলাদেশ লক্ষ্মী পূজা টোটকা রেসিপি সম্পর্ক একাদশী ব্রত পড়াশোনা খবর ফ্যাশন টিপস