তিস্তায় ধস ভয়াবহ ভাবে দুলে উঠল চারপাশ। কেমন একটা মড়মড় শব্দ ভেসে এল মাটির গভীর থেকে। তারপর তিস্তার পাড় বরাবর বিরাট এলাকা কেমন যেন গুটিয়ে নেওয়া মাদুরের মতো কুঁচকে, দুমড়ে গিয়ে ধসে পড়ল পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তায়। আপাত ভাবে মনে হতে পারে উত্তরবঙ্গ থেকে সিকিম যাওয়ার এনএইচ-১০-কে পটভূমি করে একটা ডিজ়াস্টার মুভি বানাতে চলেছেন হলিউডের কোনও পরিচালক। যদি তেমন হতো, তাহলে বিষয়টা তেমন চিন্তার কিছু হতো না।
কিন্তু অক্টোবরে ব্রিটিশ ও জার্মান অ্যাকাডেমিক প্রকাশনা সংস্থা স্প্রিংগার-নেচার প্রকাশিত ল্যান্ডস্লাইডস বিজ্ঞান পত্রিকায় ছাপা একটি প্রবন্ধে এমনই ভয়াবহ যে আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছে, সেটা কোনও ফিল্মের গপ্পো নয়। ওই প্রবন্ধে বাংলার সাত গবেষক মিলিত ভাবে গবেষণা করে দেখিয়েছেন, শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক পর্যন্ত বিস্তৃত ১১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এনএইচ-১০ এবং ওই জাতীয় সড়ক সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকার ভাগ্য আক্ষরিক অর্থেই সুতোয় ঝুলে রয়েছে।
এনএইচ-১০ নিছক একটা রাস্তা নয়, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের কাছে এটা মহাধমনী। এই রাস্তার ৯২ কিলোমিটার অর্থাৎ ৮০ শতাংশই পার্বত্য এলাকা ধরে এগিয়েছে। জাতীয় সড়কের পাশ দিয়ে প্রায় গোটা পথটাই বয়ে গিয়েছে তিস্তা। কাজেই ওই এলাকায় সামান্য ভূতত্ত্বগত পরিবর্তন হলেই জাতীয় সড়কের নদীগর্ভে ধসে পড়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। ৩ অক্টোবর ২০২৩। বেনজির প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নেমেছিল সিকিমে। সে রাতে সাউথ লোনার লেকের পাড় ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল বিপুল জলস্রোত। সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের (সিডব্লুসি) রিপোর্ট অনুযায়ী সাংকালাং অঞ্চলে জলের স্রোত সর্বোচ্চ সীমার ৬০ ফুট পর্যন্ত উপরে উঠেছিল। ওই বিপর্যয়ের পর সারা বিশ্বের ভূগোল বিশারদ এবং ভূতত্ত্ববিদরা ওই বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে নেমেছিলেন।
তাঁদের মধ্যে ছিলেন সিধো-কানহু-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোলের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ বেরা ও সৌমিক সাহা এবং যোগেশচন্দ্র চৌধুরী কলেজের সুমনা ভট্টাচার্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেবাশিস ঘোষ এবং লাপকা তামাং, ডায়মন্ড হারবার উইমেন্স ইউনিভার্সিটির নৈঋতা সেনগুপ্ত ও রাজা নরেন্দ্রলাল খান উইমেন্স কলেজের প্রভাতকুমার শিট। বিজ্ঞানপত্রিকায় তাঁদের গবেষণার ফল প্রকাশ হওয়ার পর বিশ্বজিৎ বেরা ‘ আজবাংলা কে বলেন, ‘আমরা উত্তরবঙ্গে এবং সিকিমের বিভিন্ন জায়গায় সমীক্ষা চালিয়ে যে লক্ষণ দেখেছি সেটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমরা দেখেছি, উত্তরের বিস্তীর্ণ এলাকায় মাটির বুনোট অত্যন্ত আলগা। গোটা এলাকায় বৃষ্টির পরিমাণ খুব বেশি। তাই বিরাট এলাকা জুড়ে ধসের আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে।’
গবেষক এই প্রসঙ্গে কয়েক বছর আগের যোশীমঠ বিপর্যয়ের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের তুলনা করে বলেন, ‘যোশীমঠের পথেই হাঁটছে আমাদের তিস্তা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকাও। ওখানকার মতোই এই জায়গাতেও গত দু’দশকে এত বেশি অপরিকল্পিত নির্মাণ গড়ে উঠেছে যেটা এলাকার ভারসাম্য পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে।’ এর সঙ্গে বিশ্বজিৎ যোগ করেছেন তিস্তার নদীবক্ষে যেখানে-সেখানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির বিষয়টাও। জানিয়েছেন, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির জন্য রিভার বেডে যে বেহিসেবি নির্মাণ চলছে, সেটাও ভয়াবহ বিপর্যয়ের পথই প্রশস্ত করছে।
পামির গ্রন্থি, তিব্বতের মালভূমি এবং তাকে বিভিন্ন দিক থেকে ঘিরে রাখা হিমালয়, কারাকোরাম, হিন্দুকুশ, কুনলুন এবং তিয়েনশান পর্বতসঙ্কুল এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রায় ৪৬ হাজার হিমবাহ রয়েছে।এর মধ্যে শুধু হিমালয় থেকেই ২০ হাজারের বেশি হিমবাহ তৈরি হয়েছে। গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র, আমু দরিয়া, সির দরিয়া, মেকং, ইরাওয়াড্ডির মতো বিরাট নদীগুলো ওই হিমবাহরই ফল। জল এবং বরফ মিলে এই বিরাট এলাকা এত বেশি জল সঞ্চয় করে রেখেছে যে ভূতত্ত্ববিদদের একাংশ এই অঞ্চলকে ‘এশিয়ান ওয়াটার টাওয়ার’ বলে উল্লেখ করেন।
গত কয়েক বছরে বহু হিমবাহই সঙ্কুচিত হয়েছে। হিমবাহ আকারে ছোট হয়ে যত ‘গুটিয়ে’ গিয়েছে, তত বেশি সংখ্যায় তৈরি হয়েছে গ্লেসিয়াল লেক বা হিমবাহ-গলা হ্রদ। এদেরই অন্যতম সাউথ লোনার লেক। সিকিম ও উত্তরবঙ্গে বিপুল বৃষ্টির দৌলতে এই হ্রদগুলোর বেশির ভাগই কানায় কানায় ভরে থাকে। একদিকে মাটির আলগা বুনোট এবং তার পাশাপাশি গোটা এলাকার অস্থির ভূতত্ত্ব এমনিতেই এলাকার ঝুঁকি বাড়িয়ে রেখেছিল, আর এর সঙ্গে ক্লাউডবার্স্টের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় যুক্ত হয়েই সাউথ লোনার লেকের পাড় ভেঙেছিল। তাই ওই ঘটনাকে আদৌ ‘ব্যতিক্রমী’ বলে মনে করছেন না বাংলার এই গবেষকরা। স্প্রিংগার-নেচারের ল্যান্ডস্লাইডস পত্রিকায় তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী — তিস্তায় ধস উত্তরবঙ্গ-সিকিমে বিপদের পরিস্থিতি তৈরিই আছে। তিস্তায় ধস ভয়াবহ বিপর্যয় শুধু সময়ের অপেক্ষা।
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হতে ক্লিক করুন Aaj Bangla হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।