সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ (Satyendra Prasanna Sinha) একজন বাঙালি ভারতীয় আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদ যিনি বিহার ও ওড়িশার প্রথম গভর্নর, বাংলার প্রথম ভারতীয় অ্যাডভোকেট – জেনারেল । তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি নির্বাহী পর্ষদের সদস্য ছিলেন সেইসঙ্গে ছিলেন ব্রিটিশ মন্ত্রকের সদস্য। ১৮৬৩ সালের ২৪ মার্চ বীরভূম জেলার রায়পুরের এক জমিদার পরিবারে সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহের জন্ম হয়। তাঁর আদি বাড়ি ছিল দক্ষিণবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায়। তাঁর বাবা ও মায়ের নাম যথাক্রমে সিতিকণ্ঠ সিংহ ও মোহিনী দেবী।
বাবা মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন সত্যেন্দ্র প্রসন্ন। ১৭৬৪ সালে লালচাঁদ দে, সত্যেন্দ্র প্রসন্নর পূর্বপুরুষ, একহাজার তন্তুবায় শ্রমিক নিয়ে মেদিনীপুর ছেড়ে অজয় নদীর তীরে অবস্থিত এই রায়পুরে এসে ওঠেন এবং ব্যবসা বাণিজ্য করে কয়েক বছরের মধ্যে অর্থনতিক ভাবে বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠলে স্থানীয় জমিদার ১৭৭০ সালে লালচাঁদ দে’র কাছে তাঁর জমিদারি বিক্রি করে দিলে লালচাঁদ দে ঐ এলাকার জমিদার হয়ে যান।শৈশবে সত্যেন্দ্র প্রসন্নর পড়াশুনা শুরু হয় বীরভূম জিলা স্কুল থেকে। ১৮৭৭ সালে চোদ্দ বছর বয়সে এখান থেকে বৃত্তি সহ এন্ট্রান্স পাশ করে ১৮৭৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং এখান থেকেই এফ.এ পাস করেন। ১৮৮০ সালে সত্যেন্দ্র প্রসন্নের সাথে গোবিন্দ মোহিনী সিংহের বিয়ে হয়। ১৮৮১ সালে আইন পড়ার জন্য দাদা চিকিৎসক নরেন্দ্র প্রসন্ন সিংহের এর সাথে হেনরি আর্স্কিনের সহায়তায় ইংল্যান্ড যান তিনি।
লন্ডনে অবস্থিত ‘লিঙ্কনস ইন’ বিচারক ও আইনজীবীদের বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পেশাদার সংস্থা। ইংল্যান্ডে চার বছর পড়াশোনার পর তিনি এই ‘লিঙ্কনস ইন’-এ যোগ দেন। পড়াশোনায় কৃতিত্বের জন্য সেখানে তিনি বহু পুরস্কার লাভ করেন এবং পড়াশোনা শেষে ৫৫০ গিনি উপহারও পান। ১৮৮৬ সালে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরেন সত্যেন্দ্র প্রসন্ন।তৎকালীন বাঙালি সমাজে বিদেশ যাওয়াকে ভালো চোখে দেখা হত না। তাই বিদেশ থেকে ফিরলে দুই ভাইকেই জাতিচুত্য করা হয় সেইসাথে জমিদার বাড়িতে প্রবেশনিষিদ্ধ করা হয়। মনক্ষুন্ন হয়ে কলকাতায় ফিরে এসে সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সে বছর থেকেই কলকাতায় আইন অনুশীলন শুরু করেন। ব্যারিস্টার হিসেবে জীবন শুরু করলেও প্রথম দিকে অন্যান্য জুনিয়র ব্যারিস্টারের মত তিনিও সেভাবে পেশাগত সাফল্য অর্জন করতে পারেননি।
ফলত আইন অনুশীলনের পাশাপাশি তিনি সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন ও সেইসঙ্গে পাইকপাড়া রাজবংশী কলেজে পরামর্শদাতা হিসেবে কাজে যোগ দেন। ১৮৯৪ সালে একটি মামলার সাক্ষী মি. ফার নামক একজন ইউরোপীয়কে সত্যেন্দ্র প্রসন্ন এমন দক্ষতার সাথে জেরা করেন যে আদালতে উপস্থিত সকল আইনজীবি ও জনগণ বিস্মিত হয়ে যান।তাঁর মোকদ্দমা পরিচালনাও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই মামলা থেকেই (Satyendra Prasanna Sinha) সত্যেন্দ্র প্রসন্নর নাম ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর আইন ব্যবসাও বাড়তে থাকে। ১৯০৪ সালে সরকার তাঁকে স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল (Standing Counsel)-হিসেবে নিয়োগ করে। এর দু বছর পর ১৯০৬ সালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে তাঁকে বাংলার অ্যাডভোকেট জেনারেল নিযুক্ত করা হয় এবং ১৯০৮ সালে দ্বিতীয় বার স্থায়ীভাবে ওই পদে নিযুক্ত করা হয়। মর্লে মিন্টো সংস্কারের পর তিনি তৎকালীন বড়লাট লর্ড মিন্টোর ইচ্ছেয় ১৯০৯ সালে গভর্নর জেনারেলের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন।
ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এই পদ পেয়েছিলেন, তবে এক বছর পর স্বেচ্ছায় এই পদ ত্যাগ করে তিনি পুনরায় হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি শুরু করেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলে ভারতে এই বিশ্ব যুদ্ধের জন্য যুদ্ধ পরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে বিকানের মহারাজ, গঙ্গা সিং এবং সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহকে ইংল্যান্ড পাঠানো হয়।বছর খানেক পরে তিনি দেশে ফিরে এলে তাঁকে সরকারের শাসন পরিষদের অন্যতম সদস্য নিয়োগ করা হয়। ১৯১৫ সালে নববর্ষ দিবসে তাঁকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।১৯১৯ সালে বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হলে শান্তি সম্মেলন-এ ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য অন্যান্য প্রতিনিধিদের সাথে সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ কেও ইউরোপে পাঠানো হয়। শান্তি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হলে তাঁকে ‘লর্ড’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়। ভারতের মধ্যে তিনিই প্রথম এবং একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। ব্রিটিশ ‘হাউস অব লর্ডস’-এর প্রথম ভারতীয় হিসেবে ওই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি তাঁর আসন গ্রহণ করেন।
১৯১৯ সালে ভারতের জন্য নতুন শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়। ভারত সচিব মন্টেগু এবং লর্ড মিন্টো এই শাসন বিধি প্রণয়ন করেন, যা ইতিহাসে পরিচিত মন্টফোর্ড স্কীম নামে। ‘হাউস অব লর্ডস’-এ আইনটি পাশ হওয়ার পর ১৯২০ সালে এটির কার্য শুরু হলে সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহকে বিহার ও ওড়িশার গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি এই প্রাদেশিক গভর্ণর পদ পেয়েছিলেন।১৮৯৬ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। ১৯১৫ সালে বোম্বাই অধিবেশনের সভাপতিত্বও করেছিলেন তিনি। সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহের নানান পদ মর্যাদা ও সম্মান প্রাপ্তি রায়পুরের জমিদার বাড়িকে বিখ্যাত করে তোলে। সেই জমিদার বাড়ি আজও বিখ্যাত তাঁরই জন্য। তবে সেই বাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে আরও এক ইতিহাস।বর্তমানের শান্তিনিকেতনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই প্রসন্ন পরিবারের নাম । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সাথে সখ্যতা ছিল জমিদার ভুবনমোহন সিংহের।
একবার ভুবনমোহন বাবুর আমন্ত্রণে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ কিছুদিন রায়পুরের জমিদার বাড়িতে কাটান। এই সূত্রে কলকাতার কোলাহল থেকে দূরে গাছগাছালিতে ভরা এই নির্জন লালমাটির দেশকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ ভালোলাগে। তিনি তাঁর বন্ধু ভুবনমোহনের কাছে এখানে জমি কেনার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। ১৮৬৩ সালে রায়পুরের জমিদার বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার ভেতরে দুটো ছাতিম গাছ সহ কুড়ি একর জমি বছরে ৪০০০ টাকা দামে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিজ নেন। আজকের শান্তিনিকেতন এই জমিতেই গড়ে উঠেছে।রাজনীতিবিদ ও আইনজীবীর পরিচয়ের বাইরেও (Satyendra Prasanna Sinha) সত্যেন্দ্র প্রসন্ন ছিলেন অন্যরকম এক মানুষ। তিনি তিন কন্যা ও চার পুত্রের পিতা ছিলেন, ছিলেন একজন সুপাঠকও। বন্ধু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বালিগঞ্জের বাড়িতে সাহিত্য আলোচনার যে আসর বসতো সেখানে তারকনাথ পালিত, বিহারীলাল গুপ্ত, উমেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মনমোহন ঘোষ প্রমুখের সাথে সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহের নিয়মিত যাতায়াত ছিল সেই সভায়।
সাহিত্য পাঠ ছাড়াও তাঁর বিজ্ঞানে আগ্রহ ছিল। জগদীশ চন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের জন্য যে কমিটি গঠন করা হয় তার একজন সদস্য ছিলেন সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ। এছাড়াও তিনি রায়পুরে তাঁর বাবার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ‘রায়পুর সিতিকণ্ঠ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়’ স্থাপন করেন। তিনি রায়পুরে ‘সিনহা সদন’ নির্মাণের জন্যও অনুদান দিয়েছিলেন।পরবর্তীকালে এই ‘সিনহা সদন’- এ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ডক্টরেট উপাধি প্রদান করা হয়। সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ তাঁর জীবনে অনেক সম্মান পেলেও হয়ত আরও কিছু সম্মান প্রাপ্তি তাঁর বাকি থেকে গেছে। সেখানে বাধা হয়েছে তাঁর জীবনের পরিসর। বিহার ওড়িশার প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হলেও তিনি বেশিদিন এই পদ অলঙ্কৃত করতে পারেননি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ১১ মাস পর তিনি এই পদ ত্যাগ করেন। মাত্র ৬৪ বছর বয়সে ১৯২৮ সালের ৪ মার্চ বহরমপুরে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যু হয়। কলকাতায় তাঁর সম্মানে লর্ড সিনহা রোড নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।