কালীপূজা Kali Puja বা শ্যামাপূজা হিন্দু দেবী কালীর পূজাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত একটি হিন্দু উৎসব। প্রধানত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এই উৎসব উপলক্ষে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষিত হয়। বাংলায় গৃহে বা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত কালীপ্রতিমার নিত্যপূজা হয়ে থাকে। কার্তিক মাস, অমাবস্যা তিথি। আলোয় মুড়ে থাকে গোটা শহর। সাড়ম্বরে পালিত হয় কালীপুজো ও দীপাবলি। রাতভর চলে পুজো। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আতসবাজির রোশনাই। একই দিনে সন্ধ্যাবেলা বহু ঘরে পূজিত হন মা লক্ষ্মী। প্রদীপের আলোয় সেজে ওঠে ঘরের উঠোন, বারান্দা।
মহালয়া অর্থাৎ পিতৃপক্ষের অবসান এবং মাতৃপক্ষের শুভারম্ভ। এই সময় বিদেহী আত্মারা জল গ্রহণের জন্য মর্ত্যে আসেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, তাঁরা দীপাবলি পর্যন্ত মর্ত্যেই থাকেন। দীপাবলির অমাবস্যা তিথিতে ফের আত্মারা ফিরে যান স্বর্গলোকে। অন্ধকারে যাতে পিতৃপুরুষদের ফিরে যেতে কোনও অসুবিধা না হয়, তাই তাঁদের পথ আলোকিত করে রাখতেই ঘরে ঘরে জ্বালানো হয় প্রদীপ। এই তিথির নাম তাই দীপান্বিতা অমাবস্যা। এই সময়ে হওয়া Kali Puja কালীপুজোকে তাই দীপান্বিতা কালীপুজোও বলা হয়। বঙ্গীয় তন্ত্রসার, শ্যামারহস্য প্রভৃতি তন্ত্রে কালীর বিভিন্ন রূপের কথা বলা হয়েছে, যথা: দক্ষিণ, সিদ্ধ, গুহ্য, ভদ্র, শ্মশান, রক্ষা ও মহাকালী। এঁদের মধ্যে দক্ষিণকালিকা সর্বাধিক জনপ্রিয় ও ব্যাপকভাবে পূজিত।
তাঁর বর্ণনা মোটামুটি এরূপ: চতুর্ভুজা, করালবদনা, মেঘকৃষ্ণবর্ণা, মুন্ডমালিনী, মুন্ডসমূহ থেকে নিঃসৃত রক্তধারায় রঞ্জিতা, ত্রিনয়না, শিববক্ষোপরি দন্ডায়মানা এবং শিবাকুলবেষ্টিতা। তাঁর চতুর্ভুজের দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে থাকে খট্বাঙ্গ ও চন্দ্রহাস এবং বাম হস্তদ্বয়ে থাকে বর্ম ও পাশ; আর পরিধানে থাকে ব্যাঘ্রচর্ম। কালীর আবির্ভাব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, দেবাসুরের যুদ্ধে পরাজিত দেবগণের স্ত্ততিতে আদ্যাশক্তি ভগবতীর দেহকোষ থেকে দেবী কৌষিকী আবির্ভূত হন। তখন ভগবতীদেবী কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেন বলে তাঁর নাম হয় কালী বা কালিকা।
তিনি শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দুই দানবকে বধ করেন। তাদেরই দুই চেলা চন্ড ও মুন্ডকে বধ করায় দেবীর এক নাম হয় চামুন্ডা। শাক্তরা কালীকে আদ্যাশক্তিরূপে উপাসনা করেন। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ (আনু. ১৫শ-১৬শ শতক) বঙ্গদেশে দক্ষিণকালিকার পূজা প্রবর্তন করেন বলে কথিত হয়। মতান্তরে ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে কাশীনাথ রচিত শ্যামাসপর্যাবিধি-তে এ পূজার সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে বঙ্গে কালীপূজার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের (১৭১০-১৭৮৩) সময় থেকে।
ব্রহ্মযামলতন্ত্রে বলা হয়েছে ‘কালিকা বঙ্গদেশে’ অর্থাৎ বঙ্গদেশে দেবী কালিকা বা Kali Puja কালীরূপে পূজিতা হন। কলকাতার কালীঘাটের কালী এবং দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী অতি প্রসিদ্ধ। গৃহে ও মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত Kali Puja কালীর পূজা হয় নিত্য; এ ছাড়া দীপান্বিতা (কার্তিকী অমাবস্যা), মাঘী কৃষ্ণা চতুর্দশী, জ্যৈষ্ঠের কৃষ্ণা চতুর্দশী প্রভৃতি তিথিতে বিশেষ পূজার বিধান আছে। মাঘে পূজিতা দেবীর নাম রটন্তী, জ্যৈষ্ঠে ফলহারিণী। বিশেষ কোনো কামনা পূরণের জন্যও কালীপূজা হয়ে থাকে। গ্রামাঞ্চলে গুরুতর ব্যাধি মহামারিরূপে দেখা দিলে অনেকে মিলিতভাবে রোগমুক্তি কামনায় কালীপূজা করেন।দীপান্বিতা Kali Puja কালীপূজা সাড়ম্বরে আলোকসজ্জাসহ ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। কালীপূজায় সাধারণত পাঁঠা, ভেড়া কিংবা মহিষ বলি দেওয়া হয়। বিশ্বসারতন্ত্র মতে, গুহ্যকালী গোধামাংসে প্রীত হন। ডাকাতদের নরবলিসহ কালীপূজার কথাও শোনা যায়। কারও কারও মতে, কালী আদিতে ছিলেন অনার্যদেবী। তাদের যুক্তি হলো যে, কালীর রূপকল্পনা ও পরিবেশ অনার্যোচিত।
তাছাড়া অধিকাংশ দেবদেবীর পূজা হয় দিনে, কিন্তু কালীর পূজা হয় রাতে। সম্ভবত লুণ্ঠন ও দস্যুতাপরায়ণ আদিম অধিবাসীরা রাত্রির অন্ধকারে লোকচক্ষুর অন্তরালে গুপ্ত বাসস্থানে এ পূজা করত। কালক্রমে কালী আর্যদেবীরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বত্রই কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের দমদম ও বারাসাতের কালীপূজা সবচেয়ে বিখ্যাত। বাংলায় কালীপুজোকে দীপান্বিতা পুজো বা দীপাবলিও বলা হয়ে থাকে। যদিও অনেকে দীপাবলিতে লক্ষ্মী -গণেশের পুজো (Lakshmi- Ganesh Puja) করেন।
Kali Puja কালীপূজার মাধ্যমে সমাজে সংঘটিত অন্যায়ের প্রতিবাদ করার প্রেরণা পাওয়া যায়।এ পূজার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধনও স্থাপিত হয়।কালীপূজার মাধ্যমে গুরুজনদের সম্মান করার আদর্শ স্থাপিত হয়।কালীদেবীর মূর্তি জ্ঞান, কর্ম,কর্মফল ও ত্যাগের তাৎপর্য তুলে ধরে।কালীপূজার মাধ্যমে মোক্ষলাভও হয়।কালীদেবীর কোমরের হাতগুলো কর্মের তাৎপর্য তুলে ধরে ও শ্মশানবাস জীবনের শেষ পরিণতিকে নির্দেশ করে।এছাড়া মুন্ডগুলো জ্ঞানের ধারক।এছাড়াও কালীপূজার বহু তাৎপর্য আছে যা তাঁর রূপের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়।
দুর্গাপূজার মতো কালীপূজাতেও গৃহে বা মণ্ডপে মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করা হয়। মন্দিরে বা গৃহে প্রতিষ্ঠিত প্রস্তরময়ী বা ধাতুপ্রতিমাতেও কালীপূজা করা হয়। মধ্যরাত্রে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দেবীকে ছিন্নমস্তক সহ বলির পশুর রক্ত, মিষ্টান্ন, অন্ন বা লুচি, মাছ ও মাংস উৎসর্গ করা হয় গৃহস্থবাড়িতে সাধারণত অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যমতে আদ্যাশক্তি কালীর রূপে কালীর পূজা হয়। দেবীর পূজায় ছাগ মেষ বা মহিষ বলির প্রথা রয়েছে। সুদূর অতীতে নরবলি দিয়েও কালীপূজা হত।
লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কালী শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এই কারণে কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে শ্মশানে মহাধুমধামসহ শ্মশানকালী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি, কলকাতার পুরাতন ও ঐতিহ্যশালী কালীমন্দির। কোনো কোনো মণ্ডপে কালী ও শিবের মূর্তির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার দুই বিখ্যাত কালীসাধক রামকৃষ্ণ পরমহংস ও বামাখ্যাপার মূর্তিও পূজিত হয়। কোথাও কোথাও কালীর সঙ্গে সঙ্গে দশমহাবিদ্যাও পূজিত হন। দর্শনার্থীরা সারারাত ধরে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে কালীপ্রতিমা দর্শন করেন। কালীপূজার রাতে গৃহে আলোকসজ্জা সাজানো হয় এবং আতসবাজি পোড়ানো হয়। কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে এই দিন দেবী কালীকে লক্ষ্মীরূপে পূজা করা হয়। হাজার হাজার ভক্ত এই দিন কালীঘাট মন্দিরে ভিড় করেন এবং দেবীর উদ্দেশ্যে বলি উৎসর্গ করেন। কলকাতার অপর বিখ্যাত কালীমন্দির দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতেও কালীপূজা উপলক্ষে মহাসমারোহ হয়। এইখানেই অতীতে রামকৃষ্ণ পরমহংস কালী আরাধনা করেছিলেন। সেই কারণে এই মন্দিরে কালীপূজা দেখতে প্রচুর পুণ্যার্থী এখানে ভিড় জমান।
দেখে নিন এবছরের কালী পুজোর দিনক্ষণ, শুভ সময়।
কালীপুজো ২০২৪: কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে কালীপুজোর আয়োজন করা হয়। এই পুজোকে কোথাও দীপান্বিতা কালীপুজোও বলা হয়। কোথাও আবার মহানিশা নামেও এই কালীপুজোর রাত পরিচিত। এই রাতে শক্তির আরাধনা হয়। ২০২৪ সালে কখন থেকে কালীপুজোর অমাবস্যা পড়ছে দেখে নেওয়া যাক। অমাবস্যা তিথি- ৩১ অক্টোবর রয়েছে কালীপুজো। একটি মত বলছে সেদিন, দুপুর ৩ টে ০৭ মিনিট ৪২ সেকেন্ডে পড়ছে অমাবস্যা। আর অমাবস্যার এই তিথি শেষ হবে ১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৫ টা ০৮ মিনিট ০৭ সেকেন্ডে। ভিন্নমতে, ৩১ অক্টোবর দুপুর ৩ টে ৫২ মিনিটে পড়বে অমাবস্যা। পরের দিন ১ অক্টোবর দুপুর ১২ টা ৪৮ মিনিটে তিথি শেষ হবে। কালীপুজোর শুভ মুহূর্ত ৩১ অক্টোবর রাত ১১ টা ৪৮ মিনিটে পড়বে, পরদিন ১ নভেম্বর দুপুর ১২ টা ৪৮ মিনিট পর্যন্ত থাকবে।