
history of kali puja
কালী উপাসনার ইতিহাস history of kali puja in bengali মাতৃ দেবীর সমস্ত অভিব্যক্তি — বা আদি শক্তি — ভারতীয় উপমহাদেশে পূজিত, কালী তার হিংস্রতা এবং ভয়ঙ্করতার জন্য তাত্ক্ষণিকভাবে স্বীকৃত হয়। দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে পূজা করা হয় — বাংলা, আসাম, নেপাল, ওড়িশা, দক্ষিণ ভারত, উত্তর প্রদেশ এবং রাজস্থান — কালী হিন্দু সমাজের সমস্ত স্তরে এবং তার বাইরেও তার বহুত্বের জন্য বিখ্যাত। শক্তির দেবী হিসেবে শ্যামা বা কালীমূর্তির আরাধনা করেন শাক্ত বাঙালিরা।হিন্দু শাস্ত্রে বলা রয়েছে, তন্ত্র মতে যে সব দেব-দেবীদের পূজো করা হয়, তাঁদের মধ্যে কালী পুজো অন্যতম। বলা হয়, যাঁরা সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করতে চান, তাঁরা তন্ত্র-মন্ত্র ক্ষমতায় বিশ্বাসী। মানুষরূপী ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইলে নিষ্ঠা সহকারে কালী পুজো করে থাকেন ।
history of kali puja কালী (সংস্কৃত: काली) বা কালিকা (সংস্কৃত: कालिका) হলেন একজন হিন্দুধর্মের পরম আরাধ্য দেবী। তিনি দেবী আদিপরাশক্তি বা পার্বতীর একটি রূপ। তাকে মৃত্যু, সময় ও পরিবর্তনের কর্তা বলে মনে করা হয়। তন্ত্র অনুসারে কালী দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। কেরালা ব্যতীত সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে কালীকে ভগবান শিবের স্ত্রী পার্বতীর রূপ হিসাবে বিশ্বাস করা হয়। কেরালার লোকবিশ্বাস অনুসারে— ভগবান শিবের তৃতীয় নয়ন থেকে রাক্ষসদের ধ্বংস করার জন্য তিনি আবির্ভূতা হন, তাই কেরালায় তাঁকে ভৈরবোপপত্নী মহাকালী বলা হয়।
আশ্চর্যজনকভাবে, কালী হলেন ভগবদ গীতার নীতিগুলির একটি তান্ত্রিক মূর্তি – তিনি একজনের অভ্যন্তরীণ রাক্ষস এবং বাহ্যিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অভিভাবক দেবতা যা তাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এটি ধর্মতাত্ত্বিকদের প্রতিবাদের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যেহেতু হিন্দু ধর্মাবলম্বীতে কালীর আবির্ভাব বিলম্বিত, এবং গীতার লেখকত্বের পরে তার প্রত্নতত্ত্বের বিকাশ উল্লেখযোগ্যভাবে ঘটে। history of kali puja হিন্দু চিন্তাধারার মধ্যে কালীর চিরস্থায়ী উপস্থিতি আরও ভালভাবে বোঝার জন্য, আসুন অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালি শাক্ত কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের দিকে ফিরে যাই — যিনি তাঁর পূর্বসূরি শাক্ত কবি ও যোগী রামপ্রসাদ সেনকে অনুসরণ করেছিলেন। কমলাকান্তের জন্য কালী ছিলেন ‘আদিভূত’ ( ‘প্রাথমিক ব্যাপার’); ‘সনাতনী’ (‘বহুবর্ষজীবী শক্তি’); ‘শূন্যরূপ’ (‘কিছুই অপ্রকৃত’); ধর্ম বনাম ধর্মের বিভেদ ধ্বংসকারী।
শক্তির আরাধ্য দেবী কালীর উগ্র ও ভয়ংকর রূপ সৃষ্টির পেছনে আছে পৌরাণিক কারণ। ভারতে history of kali puja কালীপুজোর উত্পত্তি বিকাশ এবং প্রচলন প্রথা সম্পর্কে নানান তথ্য চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। সেই সকল তথ্য কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা কিন্তু বলা খুব মুশকিল। অতীত ঘাঁটলে তার উত্পত্তি সম্পর্কে নানান তথ্য আমরা পেয়ে থাকি। কালী মায়ের রূপের বর্ণনা আমরা সাধারণত কালীর যে রূপের দর্শন পাই, তিনি চতুর্ভূজা অর্থাত্ তার চারটি হাতযুক্ত মূর্তি । খড়গ, অন্যটিতে অসুর মুণ্ড অন্য হাতগুলিতে তিনি বর এবং অভয় প্রদান করেন। গলায় নরমুণ্ডের মালা, প্রতিকৃতি ঘন কালো বর্ণের এবং রক্তবর্ণ জিভ মুখ থেকে বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে । এছাড়াও তিনি এলোকেশি। মা কালীকে দেখা যায় শিবের বুকের উপর পা দিয়ে জিভ বার করে দাঁড়িয়ে আছেন।
কালী পূজার কালী শব্দটি কাল শব্দের স্ত্রীর রূপ, যার অর্থ হল কৃষ্ণ বর্ণ বা গুরু বর্ণ। বিভিন্ন পুরাণ থেকে থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মহামায়া মা দুর্গার অন্য একটি রূপ হল কালী। প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কালী একটি দানবীর রূপ। মহাভারতে কালীর উল্লেখ রয়েছে, সেখানে যোদ্ধা এবং পশুদের আত্মা বহন করেন যিনি, সেই তিনিই কাল রাত্রি কালী নামে পরিচিত। জানা যায়, নবদ্বীপের এক তান্ত্রিক যার নাম কৃষ্ণানন্দ তিনি বাংলায় প্রথম কালীমূর্তি বা প্রতিমা পূজার প্রচলন করেন। তার আগে মা কালীর উপাসকরা তাম্র পটে বা খোদাই করে কালীর মূর্তি এঁকে মা কালী সাধনা করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালী পূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং এইভাবে মা কালীর প্রতিমা পূজার প্রচলন শুরু। উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার বিভিন্ন ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপুজোর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়।
পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন দক্ষিণা কালী, শ্মশান কালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী ,গ্রহ কালী, চামুণ্ডা, ছিন্নমস্তা প্রভৃতি। মহাকাল সংহিতা অনুসারে মা কালীর আবার নব রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন কাল কালী, কঙ্কাল কালী, চিকা কালী এমন সব রূপের রূপের পরিচয়ও পাওয়া যায়। এছাড়াও বিভিন্ন মন্দিরে ব্রহ্মময়ী , আনন্দময়ী, ভবতারিণী, আনন্দময়ী ইত্যাদি নামেও মা কালীর পূজা বা উপাসনা করতে দেখা যায়। কালী পূজার সময়কাল দুর্গাপূজার পরবর্তী অমাবস্যাতে দীপান্বিতা কালী পূজা করা হয়। এছাড়াও মাঘ মাসে রটন্তি কালীপূজা এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজা ধুমধাম করে অনুষ্ঠিত করা হয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যায় এছাড়াও বিভিন্ন সিদ্ধ অমাবস্যায় এছাড়াও বিভিন্ন সিদ্ধ পিঠে প্রতিদিন এবং প্রতি শনি ও মঙ্গলবার মা কালী পূজার প্রচলন দেখা যায়।
পৌরাণিক কাহিনি মা কালীর উত্পত্তির পৌরাণিক ব্যাখ্যা সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী মা কালীর আবির্ভাব সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হল পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্য সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের ভয়ঙ্কর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল।দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। ফলে দেবলোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যশক্তি মা মহামায়ার তপস্যা করতে থাকেন । তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের কাছে আবির্ভূত হন এবং দেবীর শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী সৃষ্টি হয় যা কৌশিকী নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত দেবী কৌশিকী মা মহামায়া দেহ থেকে নিঃসৃত হলে কালো বর্ণ ধারণ করে যা দেবী কালীর আদিরূপ বলে ধরা হয়। কালী পূজার বিভিন্ন পদ্ধতি তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মধ্যরাত্রে অর্থাত্ অমাবস্যার রাত্রে মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে কালী পূজা করা হয়। আগেকার দিনে, দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পশু রক্ত বা পশু বলি করে উত্সর্গ করা হয়। এছাড়াও প্রসাদ হিসেবে লুচি এবং নানা ফল ভোগ দেওয়া হয়ে থাকে। গৃহস্থ বাড়িতে সাধারণত অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ মতে মা কালীর পুজা দেখা যায় ।এক্ষেত্রে অনেক সময় জমিদার বাড়িতে ছাগ বা মহিষ ছাগল বা মহিষ বলি দেওয়া হত এবং বর্তমানেও অনেক জায়গায় পশু বলির মাধ্যমে পূজার প্রচলন দেখা যায় । পুরাকালে বা প্রাচীন সময়ে বিভিন্ন ডাকাতের দল নরবলির মাধ্যমে কালী পূজা করত করত বলে শোনা যায়।
দেবী ভাগবতপুরাণ অনুযায়ী কালীই ব্রহ্মা,বিষ্ঞু ও মহেশ্বর।তিনিই আদি অন্ত। ঋগ্বেদে উল্লেখ করা আছে আদি পরাশক্তি তথা কালীই পরমব্রহ্ম। তিনি শক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ এবং সমস্ত জীবের জননী। নির্দোষকে রক্ষা করার জন্য তিনি মন্দকে ধ্বংস করেন। সময়ের সাথে সাথে, কালীকে ভক্তিমূলক আন্দোলন ও তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের দ্বারা বিভিন্নভাবে দেবী মা, মহাবিশ্বের মা, আদিশক্তি বা পার্বতী হিসাবে পূজা করা হয়। শাক্ত ও তান্ত্রিক সম্প্রদায়রাও তাঁকে চূড়ান্ত বাস্তবতা বা ব্রহ্ম হিসেবে পূজা করে। তাঁকে ঐশ্বরিক রক্ষক হিসেবেও দেখা হয় এবং যিনি মোক্ষ বা মুক্তি প্রদান করেন।
হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের ১০.৮.৬৪ শ্লোকে কালী আবির্ভূত হয়েছে। তাকে বলা হয় কালরাত্রি (আক্ষরিক অর্থে, “গাঢ় নীল রাত্রি”) এবং স্বপ্নে পাণ্ডব সৈন্যদের কাছে দেখা যায়, শেষ পর্যন্ত, দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামার আক্রমণের সময় তিনি যুদ্ধের মধ্যে উপস্থিত হন। ইনি যুদ্ধে নিহত যোদ্ধৃবর্গ ও পশুদের আত্মা বহন করেন। এছাড়াও মহাভারতে ভদ্রকালীর উল্লেখ আছে, তিনি দেবী আদিশক্তি পার্বতীর রূপ। আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী নামে এক দানবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে ৮৭, ৮৮,৮৯ তম কালীর আবির্ভাব, চণ্ডমুণ্ড ও রক্তবীজ বধের কাহিনী রয়েছে। এর মধ্যে রক্তবীজ বধের কাহিনী রোমহর্ষক। রক্তবীজ শুম্ভ-নিশুম্ভের অন্যতম সহচর, এই ভয়ঙ্কর মায়াবী অসুরের রক্তবিন্দু ভূমি স্পর্শ করলেই তা থেকে অবিকল আর এক অসুরের জন্ম হত। চণ্ড-মুণ্ড নিহত হতে অসুরসেনা যখন ক্ষীণবল ও হতোদ্যম, তখন রক্তবীজ দেবী চণ্ডিকা, মাতৃকা ও দেবীবাহিনীকে বীরবিক্রমে প্রত্যাঘাত করে। প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে এক একটি অবিকল দুর্ধর্ষ অসুর, এভাবে অল্প সময়েই রক্তবীজের প্রতিলিপি ঐ অসুরদের এক বিরাট বাহিনী গড়ে ওঠে। চণ্ডিকা তখন চামুণ্ডা কালীকে বলেন: – (রক্তবীজের বাড়বাড়ন্তে) দেবকুল ভীত-বিষণ্ণ হলে মহামায়া চণ্ডিকা সহাস্যে কালীকে ত্বরিতে বল্লেন -” হে চামুণ্ডে! বদন বিস্তার কর।
আমার শস্ত্রাঘাতে রক্তবীজ ও তার রক্তজাত অসুরদের রক্তপাত নিবারণ করতে তুমি তা ভূপতিত হওয়ার পূর্বেই পান কর, আর এই দুর্দান্ত অসুরদের ভক্ষণ করতে করতে এ রণক্ষেত্রে বিচরণ কর। (রক্তবীজ) দৈত্য রক্তশূন্য হলেই তার নিধন সম্ভব হবে”। চামুণ্ডা সে প্রস্তাবমত রক্তবীজকুলের রক্তপান ও তাদের ভক্ষণ করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করতে থাকেন। এতে কিছুক্ষণেই মূল রক্তবীজ রক্তশূন্য হয়ে পড়লে চণ্ডিকা শূলাঘাতে তাঁকে বধ করেন। দেবীমাহাত্ম্য বা শ্রীশ্রী চণ্ডীর সংস্করণে, কালীকে মাতৃকা এবং দেবীর শক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । তিনি চামুণ্ডা , অর্থাৎ চণ্ড ও মুণ্ড নামক অসুরদ্বয়ের সংহন্ত্রী।:৭২ চামুণ্ডা কালীর অন্যতম রূপভেদ।:২৪১ পাদটীকা তান্ত্রিক কালী কুল শাক্তধর্মে, কালী হলেন সর্বোচ্চ দেবী এবং তিনি সমস্ত দেবীর উৎস। যোগিনী তন্ত্রে, কালী কোলাসুর ও ঘোরাসুরকে হত্যা করেন।