পূর্ব দিকের প্রবেশ-দ্বার, West Bengalপশ্চিমবঙ্গের অনাদিকালের পুরনো ইতিহাস রয়েছে। সেই সময়ের বৈদিক কাহিনী ও মৌর্য্য, গুপ্ত ও মুঘল যুগের ইতিহাস এবং পাল ও সেন রাজ-বংশের পুরনো নথিপত্রে এই রাজ্যের ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া গেছে। বৈদিক যুগের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় যখন এই রাজ্যটি ভিন্ন অঞ্চল ও ভিন্ন জাতিগত লক্ষ-লক্ষ মানুষের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। মহাকাব্য মহাভারতের সময়কালে রাজ্যটি বিভিন্ন সর্দারদের শাসনাধীনে ছিল এবং বৈদিক-পরবর্তী যুগে এই অঞ্চল আর্যদের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল।
বাংলা অঞ্চলে ৪,০০০ বছরের পুরনো তাম্র-যুগের সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সেই সময় এই অঞ্চলে দ্রাবিড়, তিব্বতী-বর্মী ও অস্ট্রো-এশীয় মানুষ বসতি স্থাপণ করে থাকত। ইন্দো-আর্যদের আগমনের পর, খ্রীষ্ট-পূর্ব দশম শতাব্দীতে বাংলার কাছাকাছি অঞ্চলে অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধ সাম্রাজ্য তাদের রাজত্ব স্থাপণ করে। প্রথম খ্রীষ্ট-পূর্ব সহস্রাব্দে অথর্ব বেদে এই অঙ্গ, বঙ্গ এবং মগধ রাজ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। খ্রীষ্ট-পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে, বাংলার অধিকাংশ অংশই শক্তিশালী মগধ রাজত্বের একটি অংশ ছিল। এই মগধ প্রাচীন ভারতের একটি প্রাচীন ইন্দো-আর্য রাজ্য ছিল যার বর্ণনা রামায়ণ ও মহাভারতে রয়েছে।
এছাড়াও এটি বুদ্ধদেবের সময়কালীন ভারতের চারটি প্রধান রাজত্বের মধ্যে একটি। বিম্বিসার (খ্রীষ্ট পূর্ব ৫৪৪-৪৯১) ও তাঁর পূত্র অজাতশত্রু (খ্রীষ্ট পূর্ব ৪৯১-৪৬০)-র রাজত্বকালে তাদের ক্ষমতা বেড়ে ওঠে। মগধ বিহার এবং বাংলার অধিকাংশ অংশই অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ১৬-টি মহা-জনপদের (সংস্কৃতে, “মহান দেশ”) মধ্যে মগধ হল বিশেষ একটি মহাজনপদ। মগধ সাম্রাজ্য এক গণতান্ত্রিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয় যেমন রাজকুমার। গ্রামগুলি “গ্রামকা” নামে তাদের নিজস্ব স্থানীয় প্রধান ব্যক্তিদের দ্বারা নিজস্ব পরিষদের অন্তর্ভূক্ত ছিল।
তাদের প্রশাসন নির্বাহী, বিচার বিভাগীয়, এবং সামরিক ক্ষেত্রে বিভাজিত ছিল। একদা বুদ্ধদেব অর্থাভাবের জন্য গঙ্গা নদী অতিক্রম করতে না পারায়, বিম্বিসার সমস্ত সন্ন্যাসীদের জন্য নদী তীরের টোল স্থগিত করে দেন, কারণ তিনি জৈন ও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন। খ্রীষ্টপূর্ব ৩২৬ সময়কালে, আলেকজান্ডারের সেনা মগধের নন্দ সাম্রাজ্যের সীমানায় তটস্থ হয়। সেনাবাহিনী, গঙ্গা নদীতে এক অপ্রত্যাশিত বিশাল ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হয় এবং তারা ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এই সময় হায়পাসিস (আধুনিক বিপাশা)-তে বিদ্রোহের মুখে পড়ে ফলে, তারা আরও পূর্বদিকে এগোতে অস্বীকার করে। আলেকজান্ডার, তার কর্মকর্তা কোয়েনাসের সাথে বৈঠকের পর প্রত্যাবর্তনই শ্রেয় মনে করেন।
মগধ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, মৌর্য সাম্রাজ্যের আসন ছিল যা বিখ্যাত সম্রাট অশোকের অধীনে প্রায় দক্ষিণ এশিয়া, পারস্যের কিছু অংশ এবং আফগানিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে এবং তারপর, শক্তিশালী গুপ্ত সাম্রাজ্য, যা উত্তর ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্য এবং আফগানিস্তানের কিছু অংশের উপর বিস্তৃতি লাভ করে। খ্রীষ্ট পূর্ব ১০০ শতকে গ্রীকের একটি প্রাচীন বিদেশী প্রমাণে বাংলার গঙ্গারিডাই নামে একটি খন্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শব্দটি গঙ্গার্ধ (গঙ্গার সান্নিধ্যবর্তী ভূমি) থেকে এসেছে বলে অনুমান করা হয় এবং এটি বাংলার একটি অংশ বলে বিশ্বাস করা হয়।
উদাহরণ স্বরূপ, দিওদোরাস সিরকূলাস (খ্রীষ্ট-পূর্ব ৯০-৩০)-এর মতে “গন্ডারিদাই রাজ্যটি বৃহদায়তন ও প্রচুর সংখ্যক হাতি ছিল”। এটি বর্তমানে “গঙ্গারিডি” সভ্যতা নামে পরিচিত এবং এটি সম্ভবতঃ খ্রীষ্ট-পূর্ব ৪00 থেকে ১00 খ্রীস্টাব্দের একটি নির্দিষ্ট সময়কে বোঝায়। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণায়, সাম্প্রতিককালে তাম্র, ওপ্যাল, কোয়ার্টজ, ইত্যাদির কিছু ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে যা সেই প্রাচীন সভ্যতার অধিবাসীদের সময় ও তাদের জীবন শৈলীকে সনাক্ত করতে সাহায্য করেছে। এই খনন দ্রব্যগুলির মধ্যে যুগলবন্দী, সর্প, স্বস্তিক চিহ্ন, লাঙ্গল, ত্রিশূল, পান পাতা ইত্যাদি খোদাই করা আছে।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা অর্জনের সময় ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশটি ধর্মীয় ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়। উক্ত প্রদেশের হিন্দুপ্রধান পশ্চিমাঞ্চলটিকে নিয়ে গঠিত হয় ভারতের West Bengal পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় West Bengal পশ্চিমবঙ্গ ১৪টি জেলায় বিভক্ত ছিল— বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, কলকাতা, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, হুগলি, হাওড়া, মালদহ, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, পশ্চিম দিনাজপুর ও চব্বিশ পরগনা। বর্তমান কোচবিহার জেলা অতীতে ছিল কোচবিহার নামে এক দেশীয় রাজ্য।
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ অগাস্ট এই রাজ্য সরকারিভাবে ভারতে যোগ দেয়। ওই বছর ১২ সেপ্টেম্বর প্রশাসনিক ক্ষমতার হস্তান্তর শুরু হয় এবং তা সমাপ্ত হয় ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি। এরপর কোচবিহার West Bengal পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা হিসেবে ঘোষিত হয়। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে পূর্বতন ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর একটি গণভোটের মাধ্যমে ভারতে যোগদানের পক্ষে মতপ্রকাশ করে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে চন্দননগর ভারতভুক্ত হয় এবং ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ২ অক্টোবর এটি West Bengal পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার একটি অংশে পরিণত হয়।
১৯৫৬ খ্রিস্টব্দের রাজ্য পুনর্গঠন আইন অনুযায়ী ভাষার ভিত্তিতে ভারতীয় রাজ্যগুলির সীমানা পুনর্নির্ধারিত হয়। এই আইন বলবৎ হলে বিহারের একটি অংশ পশ্চিম দিনাজপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ নভেম্বর বিহারের মানভূম জেলার পুরুলিয়া মহকুমাটি একটি পূর্ণাঙ্গ জেলার আকারে West Bengal পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়।পরবর্তীকালে কয়েকটি বৃহদাকার জেলাকে ছোটো জেলায় দ্বিখণ্ডিত করা হয়। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ পূর্বতন চব্বিশ পরগনা জেলাটিকে ভেঙে উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা গঠিত হয়।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১ এপ্রিল পূর্বতন পশ্চিম দিনাজপুর জেলা ভেঙে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা গঠিত হয়। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি পূর্বতন মেদিনীপুর জেলা দ্বিখণ্ডিত করে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা গঠিত হয়। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ও তার সমর্থকেরা পুনরায় পৃথক ‘গোর্খাল্যান্ড’ রাজ্যের দাবি উত্থাপন করতে শুরু করেছেন। অন্যদিকে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ কামতাপুর পিপলস পার্টি ও তার সমর্থকেরা সমগ্র উত্তরবঙ্গ নিয়ে পৃথক ‘কামতাপুর’ রাজ্যের দাবি জানায়।
পশ্চিমবঙ্গ West Bengal , মৌর্য্য সাম্রাজ্যের বিকশিত সমৃদ্ধি ও পাশাপাশি গুপ্ত স্বর্ণযুগের প্রস্ফুটনের সাক্ষী হিসাবে রয়েছে। এই সময় বিভিন্ন রাজবংশ পশ্চিমবঙ্গের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পাল রাজবংশ, পুন্ড্র এবং সেন বংশ। পালবংশের প্রায় ৪০০ বছরের মহিমান্বিত শাসনের ইতিহাস, তার বৃহদায়তন ইতিহাসের প্রমাণ দেয়। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে সেইসময়ে ইসলামি অরাজকতার ভয়াবহতার সাক্ষী রয়েছে, যা মুঘল সাম্রাজ্য সাংস্কৃতিক অসংযত আচরণকে অনুসরণ করেছিল। মুঘল শাসনাধীনে West Bengal পশ্চিমবঙ্গ শিল্প ও বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতি লাভ করে এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠে।
তবে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং ভারত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক উপনিবেশ হয়ে ওঠে। তৃতীয় শতাব্দীতে মৌর্য্য ও গুপ্তরা তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। আনুমানিক ৮০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে একাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত পাল রাজবংশ এখানে তাদের শক্তিশালী শাসন প্রতিষ্ঠিত করে এবং তারপর সেন বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। হিন্দু রাজবংশের শাসনাধীনে এই অঞ্চলের অর্থনীতি, কলা এবং সংস্কৃতি সবচেয়ে বেশী উন্নতি লাভ করে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা, দিল্লীর সুলতানদের একটি অংশ হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে এটি মুঘলদের এক অংশ হয়ে ওঠে। মুসলিমদের নেতৃত্বের প্রভাবে ধর্মান্তকরণের পাশপাশি কলা, সংস্কৃতি ও কূটির শিল্পে ভালো উন্নতি হয়ে ছিল এবং এইসময় বিভিন্ন উৎপাদনের মধ্যে মসলিন উৎপাদন হত যার বিশ্ব জুড়ে বিশাল চাহিদা ছিল। সমুদ্রের নৈকট্যের দরুণ এখানে বৈদেশিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়- ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে পর্তুগীজরা, ১৬৩২ নাগাদ ওলন্দাজ, ১৬৭৩-১৬৭৬ এর মাঝামাঝি সময়ে ফরাসি, ১৬৭৬-এ ডেনমার্ক ও ১৬৯০-তে ব্রিটিশ।
ব্রিটিশদের আধিপত্যের বৃদ্ধি নবাবদের সঙ্গে দ্বন্দের সৃষ্টি করে। ব্রিটিশদের এক কূটনৈতিক ষড়যন্ত্রের প্রচেষ্টার মাধ্যমে তারা বাংলার সমস্ত শক্তি চুড়ান্ত ভাবে দখল করে। পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) এবং বক্সার যুদ্ধ (১৭৬৪) মুঘল শাসনের ভাগ্যকে অবদমিত করে। ব্রিটিশ পরবর্তী কালে, ইংরেজরা ১৯০৫ সালে ধর্মের উপর ভিত্তি করে প্রশাসনের দ্বি-পাক্ষিক প্রথার দ্বারা বাংলাকে ভাগ করে। ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতা ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। পরবর্তীকালে এই রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গ, প্রত্নতাত্ত্বিক বৈদিক যুগের প্রাচীন ইতিহাসে বাঙালি সংস্কৃতির একটি উপকেন্দ্র ছিল। রাজ্যের ঐতিহাসিক কাহিনীতে শক্তিশালী রাজাদের বিজয় কথা তথা চরম দুর্দশার কথা নথিভূক্ত করা আছে। সেই সময়ের ব্রিটিশ উপনিবেশের অত্যাচারিত দিনগুলির ও সেইসঙ্গে এটি স্বাধীনতার জন্য ভারতের কোলাহলপূর্ণ যুদ্ধের ক্ষেত্রে এটি কেন্দ্রগত ভূমিকা পালন করে চলেছে। বাংলার যুবক এবং বিপ্লবীরা সক্রিয়ভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। চিত্তরঞ্জন দাস, এস.এন.ব্যনার্জি, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চাকি, ক্ষুদিরাম বসু এবং রাসবিহারী বসু-র ন্যায় বুদ্ধিজীবীদের সক্ষম নেতৃত্বে বাংলার মানুষ দেশপ্রেমের উৎসাহে আলোড়িত হয়ে ওঠে এবং অত্যাচারী ব্রিটিশ রাজত্ব থেকে তাদের দেশকে মুক্তির জন্য তৎপর হয়ে ওঠে।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে এডলফ্ হিটলারের নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন। পূর্ব ভারতের এই প্রবেশদ্বার পশ্চিমবঙ্গ, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং মহিমান্বিত ইতিহাসে সমৃদ্ধ। রাজ্যটি কয়েকটি প্রাচীন শক্তিশালী শাসকের রাজত্ব ছিল এবং মুঘল সংস্কৃতির অংশ ছিল। পাশাপাশি, রাজ্যটি বিভিন্ন বিদেশী জাতির একটি প্রতিষ্ঠিত উপনিবেশ ছিল ও অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের দ্বারা বশীভূত ছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার সুপরিচিত ব্যবসার সম্ভাবনার জন্য দেশে ব্যবসায়িক কেন্দ্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে ভারতে আসে। পশ্চিমবঙ্গে, ব্রিটিশদের প্রথম উল্লেখযোগ্য পদার্পণ হয়েছিল যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক প্রতিনিধি জব চার্নক, একটি যোগ্য বাণিজ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য সূতানুটি, গোবিন্দপুর ও কোলিকাতা নামে তিনটি বৃহত্তম গ্রামকে নিয়ে এই অঞ্চল গঠন করেন। এই তিনটি গ্রাম একসঙ্গে আধুনিক কলকাতা নামে পরিচিত। এই শহর কেন্দ্রিক মহানগরটি হল বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী।
বৈদিক পরবর্তী যুগ পশ্চিমবঙ্গ তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারিক সম্পত্তির গৌরবে আচ্ছন্ন হয়েছিল যা রাজ্যের পুরনো যুগের ইতিহাসের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণ দেয়। এই পুরনো ইতিহাসের কাহিনী থেকে পুরনো দিনের বৈদিক যুগের সম্পর্কে একটা ধারণা করা যেতে পারে। সাধারণভাবে এই বৈদিক পরবর্তী যুগ থেকে সেই সময়ের অনুমান করা যায় যখন আর্যরা এই বাংলার ভূ-খন্ডে অধিষ্ঠিত ছিল। খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০ থেকে ১০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বিদেশী গ্রীক ভ্রমণকারীদের ঐতিহাসিক বর্ণনায় গঙ্গারিডাই নামে একটি স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায় যা বর্তমান বাংলা ছাড়া আর অন্য কিছু নয় বলেই অনুমান করা হয়। গঙ্গা ও তার বক্ষের ভূমি গঙ্গার্ধ ব্যুৎপত্তিগত ভাবে এক তাৎপর্য্যপূর্ণ। পূরাণ মতে, এই গঙ্গারিডাই-তে বিশ্বের উদ্ভবের সূচনা হয় বলে অনুমান করা হয়। এই বৈদিক পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে পাল ও সেন শাসকদের মহিমান্বিত শাসন চরম জায়গায় ত্বরান্বিত হয়, তাঁদের শাসনের অধীনে বাংলায় ব্যবসা, বাণিজ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থে ১৬-টি মহাজনপদের উল্লেখ রয়েছে যা বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির এক পীঠস্হান ছিল।
পুরা প্রস্তর যুগ এই অঞ্চলে ৪২,০০০ হাজার বছরের প্রাচীন মানববসতির উপস্থিতির প্রমাণ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, মাইক্রোলিথিক সময়কালের অন্তর্গত। এই মানব বসতি অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে কানা ও মহাদেববেরায় আবিষ্কৃত হয়েছে। কানা থেকে প্রাপ্ত মাইক্রোলিথিক সরঞ্জামগুলি ৪২,০০০ বছরের পুরাতন এবং মহাদেবেরায় থেকে প্রাপ্ত মাইক্রোলিথিক সরঞ্জামগুলি ৩৪,০০০ থেকে ২৫,০০০ বছরের পুরাতন। ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরবর্তী হাটপাড়ায় প্রায় ১৫,০০০-২০,০০০ বছরের প্রাচীন মানব বসতির প্রমাণ মিলেছে। এখানে পাথরের তৈরি প্রায় ২০০ টি ছোট অস্ত্রের সন্ধান মিলেছে। এছাড়াও এখানে শস্য জাতীয় দানা ও মাছের হাড় পাওয়া গিয়েছে। প্রত্ন বিশেষজ্ঞদের মতে, হাটপাড়ার প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা গণকর থেকে মহীপাল পর্যন্ত ভাগীরথীর পাড় বরাবর বিস্তৃত ছিল। এই এলাকার মানুষের খাদ্যাভাসের মধ্যে মাছের ব্যাপক ব্যবহার ছিল, এবং সেগুলি যে পুড়িয়ে খাওয়া হত তাও বোঝা যায় আবিষ্কৃত মাছের কাঁটাগুলির তামাটে রং দেখে। পাঁচটি প্রধান নদী উপত্যকায় নব্য প্রস্তর সংস্কৃতি সংঘটিত হয়েছিল, যেগুলি হল অজয়-ময়ূরাক্ষী নদী উপত্যকা, দারাকেশ্বর—দামোদর নদ উপত্যকা, গন্ধেশ্বরী নদী উপত্যকা, তারাফেনী নদী উপত্যকা ও সুবর্ণরেখা নদী উপত্যকায় অবস্থিত। এছাড়াও কালিম্পঙে একটি নব্য প্রস্তর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। প্রত্নক্ষেত্রগুলি থেকে উদ্ধার করা প্রধান যন্ত্রগুলির মধ্যে রয়েছে সেল্ট (অক্ষ ও অ্যাডজেস উভয়), ওয়েজ, চিসেল, ছিদ্রযুক্ত সরঞ্জাম ও পাউন্ডার, মাইক্রোলিথ এবং হাড়ের সরঞ্জাম।
তাম্র যুগ মূলত তাম্র বস্তুর আবির্ভাবের সঙ্গে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে শুরু হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের তাম্র বা চ্যালকোলিথিক সংস্কৃতি পরবর্তী হরপ্পান (হরপ্পান ৫) ও বৈদিক সভ্যতার সমসাময়িক। অজয়-দামোদর উপত্যকায় একটি তাম্র সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছিল। আনুমানিক ১৫০০ – ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তাম্র সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। এই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত শহরগুলি ছিল আধুনিক বর্ধমান বিভাগের পাণ্ডু রাজার ঢিবি, মঙ্গলকোট ও ভরতপুর এবং আধুনিক মেদিনীপুর বিভাগের ডিহর। অজয় নদের দক্ষিণ তীরের তাম্রযুগীয় একটি প্রত্নক্ষেত্র হল পাণ্ডু রাজার ঢিবি, যেখানে সর্পিল চুড়ি, আংটি ও মাছ ধরার হুক পাওয়া গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে, কালো ও লাল মৃৎপাত্র সংস্কৃতি হল আনুমানিক ৭০০ – ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে মধ্য ও পূর্ব গঙ্গা সমভূমিতে বিকশিত একটি তাম্রযুগ ও প্রারম্ভিক লৌহ যুগীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কৃতি, পরবর্তীতে এটি উত্তরাঞ্চলীয় কালো পালিশ মৃৎপাত্র সংস্কৃতি দ্বারা অনুসৃত হয়েছিল।
লৌহ যুগ লৌহ যুগে মুদ্রা, ধাতব অস্ত্র, কৃষি ও সেচের বিকাশ ঘটেছিল। পশ্চিমবঙ্গের বহু প্রত্নস্থল তাম্র যুগ থেকে লৌহ যুগের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিম অংশে লৌহ যুগের প্রত্নস্থলগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের লৌহ যুগে যে সংস্কৃতিটি গড়ে অথেছিল উঠেছিল সেটি হল নর্দার্ন ব্ল্যাক পলিশড ওয়্যার সংস্কৃতি। আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম অংশ (বাহিরি), মেদিনীপুরের পশ্চিম অংশ (কাঁকরাঝোর, ধুলিয়াপুর), পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়া (তুলসীপুর, কুমারডাঙ্গা) অঞ্চলগুলি লোহার প্রধান উৎপাদক ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছিল। ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারত অনুসারে, বঙ্গ রাজ্যের পশ্চিমাংশ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত ছিল। বঙ্গকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপনিবেশ সহ একটি থ্যালাসোক্রেসি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার ইতিহাস অনুসারে, শ্রীলঙ্কার প্রথম রাজা ছিলেন রাজকুমার বিজয়, যিনি লঙ্কা দ্বীপ জয় করতে ভারত থেকে যাত্রাকারী একটি নৌবহরের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
বাংলার লৌহ যুগে পশ্চিমবঙ্গ মগধকেন্দ্রিক সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। তব, সমসাময়িক গ্রীক বিবরণগুলি বাংলার গঙ্গাঋদ্ধিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করে, যা আধুনিক পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে জুড়ে গড়ে উঠেছিল, যদিও ইঙ্গিত করে যে মগধ ও গঙ্গাঋদ্ধি একই সার্বভৌম দ্বারা শাসিত হয়েছিল। ইতিহাসবিদ হেম চন্দ্র রায়চৌধুরী তত্ত্ব করেন যে নন্দরা বর্তমান বিহার ও উত্তর প্রদেশে তাদের মূল অঞ্চলগুলির উপর কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করেছিল, কিন্তু তাদের সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী অংশগুলিতে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসনের অনুমতি দিয়েছিল। কলকাতা থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে পুনর্ভবার তীরে অবস্থিত বাণগড়ে মৌর্য যুগ থেকে পাল যুগ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের আদি ইতিহাসের প্রমাণ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের লৌহ যুগের নিদর্শন এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে, যা প্রাক-মৌর্য, মৌর্য ও শুঙ্গ যুগের অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমবঙ্গ প্রতিটি মগধ সাম্রাজ্যকে সমুদ্রপথ সরবরাহ করেছিল। সাম্রাজ্যগুলি তাম্রলিপ্ত সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমুদ্র বাণিজ্য পরিচালনা করত, যা আধুনিক দিনের তমলুক শহরের কাছে অবস্থিত ছিল। ডারিয়ানের মতে, মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তাম্রলিপ্তি সমগ্র অববাহিকার প্রধান বন্দর হিসেবে সর্বজনীন জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই বন্দরে সিলন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম ভারত ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে জাহাজ আসত। বিদ্যাধরী নদীর তীরে চন্দ্রকেতুগড় নামে আরেকটি বন্দর শহর অবস্থিত ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে, এখানে মৌর্য ও শুঙ্গ যুগের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। খননকার্যে পোড়ামাটির বা টেরাকোটার মূর্তি ও রথ পাওয়া গিয়েছে।
পুন্ড্র রাজবংশ প্রাচীনকালের ইতিহাস ও পূরাণ মতে, পুন্ড্র রাজবংশ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করে। পুন্ড্র, পৌন্দ্র বা পৌন্দর্য্য এই নামেও স্বীকৃত রয়েছে যা পূর্ব ভারতের উপর নিয়ন্ত্রণের প্রতিষ্ঠাতা রূপে এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য। পুন্ড্র রাজবংশ বিভিন্ন বিখ্যাত যোদ্ধা উপজাতিদের বংশধর বলে দাবি করে যেমন তেলেঙ্গানার পুন্ডির রাজপুত। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গ, অঙ্গ, পুন্ড্র, কলিঙ্গ এবং শূহমা রাজবংশের প্রাচীন রাজারা একই বংশের অন্তর্ভূক্ত ছিল। সম্রাট ভালির পোষ্যপূত্র হওয়ার কারণে এই রাজ্যগুলির পাঁচটি শাসকদের মধ্যে এক শক্তিশালী ভ্রাতৃত্ব-মূলক সম্পর্ক ছিল। এই পুন্ড্র, ভারতবর্ষ বা ভারতের রাজত্বে ক্ষত্রিয় উপজাতি যোদ্ধার অন্তর্গত বলে উল্লেখ রয়েছে। পুণ্ড্র রাজবংশের বৈদিক সংস্কৃতির সময়ের সাথে এর কোনও সামঞ্জস্য ছিল না। পুণ্ড্র রাজবংশের এক ক্ষমতাবান রাজা হলেন পৌন্দ্রকা বাসুদেব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনুসারী এবং তাকে অনুকরণের মতো মহান মূর্খতার জন্য ইতিহাসের পাতায় তিনি কুখ্যাত হয়ে রয়েছেন যার ফলে তার চুড়ান্ত মৃ্ত্যু নেমে আসে। অন্য আরেক শাসক, বঙ্গ পুণ্ড্র তার অপরিমেয় সাহস এবং বীরত্বের জন্য উল্লেখিত হয়ে আছেন।
সেন রাজবংশ পূর্ব ভারতের এই রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ তার শুদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতির জন্য প্রসিদ্ধ এবং তথা প্রচুর রন্ধন প্রণালীর জন্য প্রসিদ্ধ। এক সময় এই প্রদেশ বিভিন্ন প্রাচীন রাজবংশের শাসনাধীন ছিল যার মধ্যে এই সেন বংশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই রাজ্যের পুরনো ইতিহাসে অতীত যুগের পান্ডিত্য পূর্ণ বিজয়ীর বর্ণনার উল্লেখ রয়েছে। ১০৯৭ থেকে ১২২৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার প্রশাসনে সেন বংশের শাসকদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। সেন শাসকেরা পাল বংশের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী ছিল এবং তাদের শাসন বাংলার ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয়সেন তার দূরদর্শিতা এবং রাজ্য দখলের সুযোগ্য অন্তর্দৃষ্টির জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন যা দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে সামন্তচক্রের বিদ্রোহের সময় উপস্থাপিত হয়। ধীরে ধীরে, সেন বংশ বাংলার পশ্চিম প্রান্তে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এবং মদনপালের রাজত্বালে তাদের স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করে। সেন বংশের বিষয়ে প্রধান আলোচ্য বিষয় হল বাংলার ইতিহাসে প্রথম বার কোনও একটি একক সম্রাট সম্পূর্ণ বাংলায় তার শাসনকার্য চালান। সেনা শাসকেরা মূলত কর্ণাটক থেকে এসেছিল এবং তারা ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের এক মিশ্র বংশজাত ছিল, যারা ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ নামে সুপরিচিত ছিল। বাংলা সংস্কৃতির মহিমা সমন্বিত ভারতের সাংস্কৃতিক সমাবেশ পশ্চিমবঙ্গ, তার প্রাচীন ইতিহাসের জন্য উল্লেখনীয়। প্রাচীন কালের সেই ঐতিহাসিক ভূমি বৈদিক যুগের সময়কালীন এবং পাঠকেরা সেই প্রাচীন ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে তাদের পুরনো রাজাদের বিজয় গাথা ও কঠোর দুর্দশার উল্লেখ খুঁজে পায়। পশ্চিমবঙ্গে বৈদক যুগের সম্বন্ধে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় নি, এই রাজ্যের সাহিত্যের অতি অল্প তথ্য ও কিছু মুদ্রাসংক্রান্ত প্রমাণ এবং মৃৎশিল্পের কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। প্রাচীন বেদে অতীত কালে পশ্চিমবঙ্গ, বঙ্গ নামে পরিচিত ছিল। ব্যুৎপত্তিগত গবেষণায়, বাংলা শব্দটির সুপারিশ করা হয়, স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, বাংলা একটি নির্দিষ্ট দ্রাবিড় উপজাতি “বঙ্গ”-র হিসাবে তার নাম ও সংজ্ঞার প্রতিও যথেষ্ঠ ঋণী। এই অতিথিপরায়ণ রাজ্যটি মিশ্র জাতিভুক্ত ও নানারকম মূলগত সংমিশ্রিত মানুষ দ্বারা অধ্যুষিত ছিল, যার ফলস্বরূপ এখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।
মৌর্য্য সাম্রাজ্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মিশ্রনের গুপ্তভান্ডার পশ্চিমবঙ্গের একটি সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক ধারাবিবরণী রয়েছে। রাজ্যটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বিভিন্ন বিশিষ্ট সম্রাটের সাম্রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। মগধের প্রসিদ্ধ ভূমি বাংলার এই ধরনের এক রাজ্য ছিল যা মৌর্য্য সাম্রাজ্যের রাজাদের দ্বারা শাসিত হত। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্টতা ধীরে ধীরে বিবর্ণ হতে শুরু করে। সেই সময় আমরা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং অশোকের ন্যায় শ্রেষ্ঠ রাজাদের দ্বারা শাসিত মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রসিদ্ধতার উল্লেখ দেখতে পাই। খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ষষ্ঠ শতক থেকে বাংলার এক বৃহৎ অংশ মগধ রাজত্বের অংশ হয়ে ওঠে। মগধ হল ১৬-টি মহা জনপদের মধ্যে অন্যতম যা বৌদ্ধ শিক্ষা ও সংস্কৃতির একটি প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্র হিসাবে গুরুত্ব অর্জন করে।
পালবংশ ঐতিহাসিক বিবরণী থেকে তখনকার মহিমান্বিত পাল, পুন্ড্র ও সেন রাজবংশের শাসনাধীনে পশ্চিমবঙ্গের বিকশিত হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পাল রাজারা এই ইতিহাস গঠন করার ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৪০০ বছরের পুরনো এই পাল বংশের সাম্রাজ্য West Bengal পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৮০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়, এই সময় তারা অভ্যন্তরীণ ও সেই সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্যের এক গৌরবান্বিত কেন্দ্র রূপে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাদের বাণিজ্য সংযোগ তক্ষশীলা, কম্বোডিয়া, বার্মা, শ্রীলঙ্কা, দাক্ষিণাত্য এবং পারস্যের উপসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই পাল রাজবংশ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আয়োজক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে। এই সময়, প্রথম বৌদ্ধ পাল শাসনকর্তা প্রথম গোপাল-কে বাংলার রাজা হিসাবে নির্বাচিত করা হয়। গোপালের সফল রাজত্বের পর ধর্মপাল, এই রাজবংশের সবচেয়ে প্রভাবশালী শাসক রূপে ক্ষমতায় আসে এবং ৭৭৫ থেকে ৮১০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর শাসন চলতে থাকে। তাঁর সফল রাজকার্যের পর দেবপালের রাজত্বে, পাল সাম্রাজ্যের আঞ্চলিক সীমানা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে এমনকি আফগানিস্তান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। নারায়ণ পালের সাম্রাজ্যের আমলে এই পাল বংশের ক্ষমতা এবং শক্তির পতন হতে শুরু করে। তবে প্রথম মহীপালের কার্যকরী শাসনের অধীনে সাময়িকভাবে এই পাল-বংশ পুনর্জাগরিত হয়ে উঠেছিল।
মুঘল সাম্রাজ্য পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার West Bengal পশ্চিমবঙ্গ, প্রাচীন কালের সমৃদ্ধ ও বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে জাঁকালো ভাবে প্রদর্শন করে। অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের আগে, রাজ্যটি বিবিধ রাজবংশ দ্বারা শাসিত ছিল, যেমন পাল, সেন, পুন্ড্র থেকে শুরু করে দিল্লীর সুলতানী সম্রাট ও এমনকি মুঘলরাও এখানে রাজত্ব করেন। মুঘল শাসনের সময়ে বাংলা দেশের এক বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃতি অর্জন করে। ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার দিকে মুসলিমরা বাংলার বাসস্থানের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তিন শতাব্দী ধরে নিম্নমুখী, এই রাজ্যের উপর অরাজক মুসলিম শাসকদের অগছালো অনাচার এখানে মুঘল শাসনের উদীয়মানতার পথকে প্রশস্ত করেছিল। মুসলিম শাসকেরা দেশের বাকিদের সঙ্গে তথা বিদেশের সঙ্গে দৃঢ় ব্যবসায়িক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সেইসঙ্গে তাদের রাজত্বের অধীনে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি সামুদ্রিক বাণিজ্যও এই রাজ্যে বিকশিত হতে থাকে।
ওলন্দাজ West Bengal প্রাচীন-যুগের ইতিহাস। এই রাজ্য, তার পুরনো দিনের মহিমা ও বেশ কয়েকটি শক্তিশালী রাজবংশের রাজত্বের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ে গঠিত। এটি বিভিন্ন বিদেশী ব্যবসায়ীদের একটি উপনিবেশও ছিল যেমন ওলন্দাজ, ফরাসি, পর্তুগীজ ও ব্রিটিশ। ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসে এবং দেশের সীমানার মধ্যে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে। ভারত, বা ভারতের ওলন্দাজদের চলিত কথা অনুযায়ী, সম্ভাবনার সঙ্গে বাণিজ্যের বিকাশ তাদের মুকুটের এক মণি ছিল। তারা সূর্য, সমুদ্র এবং বালি সহ চিত্রবৎ স্থান, মালাবার উপকূলবর্তী কোচিন-এ তাদের রাজধানী স্থাপন করে।
ফরাসি West Bengal পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি, পূর্ব ভারতের ব্যবসা, বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষার এক কেন্দ্র ছিল যা ইতিহাসের পাতায় অতীতের স্থান নিয়ে আছে। বিভিন্ন শক্তিশালী রাজবংশের অধীনে, রাজ্যটি ফরাসি, ব্রিটিশ, ওলন্দাজ ও পর্তুগীজদের ব্যবসায়িক উপনিবেশ হিসাবে স্থাপিত হয়েছিল। ফরাসিদের ন্যায় অন্যান্য বিদেশীরাও তাদের বাণিজ্যের স্বার্থে ভারতে আগমন করে এবং বাংলার ব্যস্তবহুল জমির ওপর তাদের শিল্প-কাঠামো স্থাপণ করে। ১৬৭৩ সালে ফরাসিরা, তৎকালীন বাংলার মুঘল রাজ্যশাসক, নবাব শায়েস্তা খানের কাছ থেকে অনুমতি চেয়ে চাঁদেরনগর বা বর্তমান নাম চন্দননগরে তাদের উপনিবেশ স্থাপণ করে। ফরাসিদের তখন মহিমান্বিত সময় ছিল কারণ তারা যা স্পর্শ করত সোনায় পরিণত হত। ১৮১৬ সালে, ফরাসিরা, বিখ্যাত নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বিরুদ্ধে অসাধারণ জয়লাভের পর, পাঁচটি পুরনো উপনিবেশ- চন্দ্রানগর, পুদুচ্চেরি, করাইকল, মাহে ও ইয়ানম এবং মছিলিপত্তনম, কোঝিকোড় ও সূরাটের বিভিন্ন পরিবেষ্টনে ফ্রান্সের আধিপত্য পুনঃস্থাপিত হয়।
পর্তুগীজ West Bengal পশ্চিমবঙ্গ, সাংস্কৃতিক প্রফুল্লতার এক আশার বাক্সের উন্মোচন করে যা এই রাজ্যের সমৃদ্ধ ইতিহাসের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণ দেয়। এই রাজ্য, যখন পাল, সেন, পুন্ড্র ও মুঘলদের শাসনাধীন ছিল তখনও এখানে এক পর্তুগীজ উপনিবেশ ছিল। বাংলায় ব্যবসা ও বাণিজ্যের সহায়ক অবস্থানের জন্য বিদেশী ব্যবসায়ীরা এই বাংলাতে আগমন করে এবং এইভাবেই তারা এই প্রদেশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। বহুকাল আগে ষোড়শ শতাব্দীতে হুগলী নদীর পশ্চিম তীরবর্তী হুগলী শহরে পর্তুগীজ ব্যবসায়ীরা তাদের ঘাঁটি স্থাপণ করে। পর্তুগীজ উপনিবেশের আগে এই হুগলী-মহৎ ভাগীরথী নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত একটি চিত্রবৎ এবং মেঠো-পল্লী গ্রাম ছিল। এখানে পর্তুগীজদের জাহাজ ও ভেসেল ছিল এবং এখান থেকেই তারা সামুদ্রিক বাণিজ্য করত ও হিজলি লবণ বিক্রি করত।
পশ্চিমবঙ্গের West Bengal সীমান্তে তিনটি রাষ্ট্র নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ এবং পাঁচটি ভারতীয় রাজ্য সিকিম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও অসম অবস্থিত। সিকিম ও ভুটান রাজ্যের উত্তরে, নেপাল উত্তর-পশ্চিমে, বিহার ও ঝাড়খণ্ড পশ্চিমে, ওড়িশা দক্ষিণ-পশ্চিমে, বঙ্গোপসাগর দক্ষিণে, এবং বাংলাদেশ ও অসম পূর্বে অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গই ভারতের একমাত্র রাজ্য যার উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই দুইয়ের মধ্যে পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে গঙ্গা রাজ্যে প্রবেশ করে পদ্মা নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে বাংলাদেশে প্রবেশের পূর্বে এর প্রধান শাখানদী হুগলি বিচ্ছিন্ন হয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ৫টি বিভাগ ও ২৩টি জেলা থেকে বেড়ে ৩০টি জেলায় হয়েছে। ১লা আগস্ট ২০২২ মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন করে ৭টি জেলার কথা ঘোষণা করেন।